ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত নাগরিকের ক্ষমতার পরিসর!

প্রীতি ওয়ারেছা : ব্যক্তিকে কখনো কখনো কোন বিশেষ দল, শ্রেণি কিংবা গোষ্ঠির প্রতি অকৃত্রিম মানসিক অধীনস্ততার উর্ধ্বে থাকতে হয়, থাকা উচিত যখন দেশ নামক বৃহৎ একটি সত্ত্বার কল্যাণের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। আমি আওয়ামী লীগের না, বিএনপির না, নারী না, পুরুষ না, মুসলিম না, হিন্দু না, সমতলের না, পাহাড়ি না- আমি কোন বিশেষ গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করতে চাই না, চাইবোই বা কেন! আমাকে বিবেচনা করুন একজন নাগরিক হিসেবে, সংবিধানে যাকে দল মত নির্বিশেষে দেশের একজন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

তার মানে আমি অগা মগা জগা কেউ নই। এই যে আমি ক্ষমতাধর একজন মানুষ সেটা বুঝবো কিভাবে? কে বোঝাবে? রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চর্চাই পারতো আমার গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্বকে মননে ও মগজে গেঁথে দিতে। কিন্তু তা ঘটেনি, শুধু কাগজে কলমে কেতাদুরস্ত বর্ণনা আছে সংবিধানের পাতায়। দেশের ষোল কোটি নাগরিকের মধ্যে কয়জন বাংলাদেশের সংবিধান পড়ার সুযোগ পেয়েছেন বলতে পারেন? আমি পাইনি। মাঝে মাঝে সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ পত্রিকা মারফত পড়ার সুযোগ ঘটেছে। তাও আবার অতি কচলানো কিছু বিষয়ের প্রেক্ষিতে সংবিধানের কোন কোন অনুচ্ছেদের বর্ণনা প্রয়োজন ছিল বলেই সেসব পত্রিকায় এসেছে এবং সেই সুবাদে আমার জানার সুযোগ ঘটেছে।

পাঠ্যক্রম নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত গবেষণা করেন তাদের কাছে আবেদন সংবিধানকে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে অবশ্যপাঠ্য একটা বিষয় করুন। তাহলে নিজ অধিকার সচেতন হবে প্রতিটি নাগরিক। যতদিন না সেটা সম্ভব হয় ততদিন সংবিধানকে পাঠক সমাজের জন্য সহজলভ্য করে দিন। আমি যদি আমার সাংবিধানিক অধিকারের ব্যাপ্তি না জানি তবে নিজের মৌলিক-যৌগিক নানা অধিকারের প্রশ্নে কণ্ঠ জোড়ালো করবো কী করে! একটি দেশ কতগুলো ও কী উপাদানে তৈরি খুঁটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে তার বিশদ না জানলে আমি সেই দেশের মেরুদণ্ডের প্রতি আস্থা রাখবো কী করে! ভেবেই বসবো দেশের পিঠ আর কোমর শক্ত না। নিজ নাগরিকত্বের মূল্যায়নই বা কিভাবে আশা করবো!

যেহেতু আমি সংবিধান শিক্ষায় শিক্ষিত না তাই ধরেই নিলাম আমি একজন নড়বড়ে নাগরিক। যেকোন ঝড় ঝাপটায় আমি শঙ্কিত চিত্তে হেলতে দুলতে থাকি। আমার এই নড়বড়ে নাগরিকসত্ত্বা তথাকথিত আঞ্চলিক কিংবা কেন্দ্রীয় হোমড়া চোমড়াদের কাছে ষোলোর ওপরে আঠারো আনার সিদ্ধি। শ্রেণি-গোষ্ঠী-সংখ্যা বিবেচনায় এনে আমার নাগরিকসত্ত্বার প্রতি হোমড়া চোমড়ারা যেকোন মুহূর্তে অনাস্থা আনতে পারে, যার কারণে তারা আমার মন্দির-প্যাগোডা ভাঙতে পারে, একই কারণে পাহাড়ি কিংবা সমতলে আমার ছাউনির ঘরে আগুন দিতে পারে, শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্বের কারণে আমার কন্যাগণ দেশের ক্ষমতাবান নাগরিকের আসন থেকে ধপাস করে পড়ে নিরেট মাংসপিণ্ডে পরিণত হতে পারে!

আমি দেশের মূল ক্ষমতার একাংশ এটা আমার ধারণাতেই নাই তাই যেকোন অসামঞ্জস্যতার বিরুদ্ধে আমার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ আসেনা। আসে শুধু হা-হুতাশ। যা ঘটছে সেটাকেই স্বাভাবিক ভেবে দিন যাপন করাই আমার বিধান। আমার জানা নাই অধিকারের প্রশ্নে নির্দিষ্ট কোন দাবি আদায়ের জন্য কার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। কেউ কেউ বলেন সব সমস্যার সমাধান সরকার প্রধানের কাছে। তিনি চাইলে সব সম্ভব। একথা জেনে সারিবদ্ধভাবে কতবার কত শত জনকে নিয়ে জাতীয় জাদুঘর আর প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ালাম! তুমুল প্রতিবাদ আর ন্যায্য দাবিতে সোচ্চার ছিল সবাই। কই সেসব কথা কেউতো শোনেনি! অপেক্ষা করতে করতে আশা ছেড়েই দিলাম। ভাবলাম পিএম এর দুটো মাত্র কান ১৬ কোটিকে কীভাবে ধারণ করবে! সাঁওতালদের ঘরের প্রতি স্থানীয়দের লোলুপ চোখ এখনো একইরকম আবদ্ধ, লংগদুদের বাড়িঘর এইতো সেদিনই পুড়লো, ধর্ষণ পাশবিকতা ডাল ভাতের মতো এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার , ধর্মের বাড়াবাড়ি কেড়ে নিচ্ছে তাজা তাজা জীবন, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কী প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, এখনতো আবার এসব নিয়ে নাকি কথাও বলা যায় না। কথা বললেই ৫৭ ধারার পুলিশ কেস আছে।

কারো অদক্ষতার বিরুদ্ধে, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে, অনিয়মের বিরুদ্ধে, স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে, কারো প্রতি ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি প্রতিবাদ করার অধিকার না থাকে এবং আমার মতো আরো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে সেই প্রতিবাদসূত্রে মূল্যায়ন করা না হয় তাহলে আমি দেশের একজন ক্ষমতাধর নাগরিক কোন অর্থে? শুধু কি ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত আমার ক্ষমতার পরিসর! জানতে চাই। আমাদের জানতে দিন।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।