মাশরাফি : কিছু স্মৃতি, কিছু দুঃখ

মাশরাফি বিন মর্তুজা কৌশিক, আমার প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ মানুষ। কী করে একজন সকলের আবেগ ও ভালবাসার মানুষে পরিনত হয় তার শ্রেষ্ঠ জীবন্ত উদাহরণ তিনি। কিন্তু পথ কি এত সহজ ছিল? উত্তর সবারই জানা— কী কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে দিনের পর দিন শুধু দেশের ক্রিকেট কে ভালবেসে, শুধু দেশকে ভালবেসে যুদ্ধ আর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন মাঠে!

সবাই বলে শুরুটা হয়েছে ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। আমি এক মত নই। মাশরাফিকে তো চিনেছি তারও আগে ২০০১ সালে অনুর্ধ্ব ১৭ (সতের) এশিয়া কাপের উদ্বোধনী খেলার তৃতীয় বলে নেপালের ওপেনার কে. চুয়াগিকে গতি আর সুয়িংয়ে পরাস্থ করে বোল্ড করার পরই। তাকে চিনেছি ওই টুর্নামেন্টেই কুয়েতের বিরুদ্ধে ১৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসে। চিনেছি চৌধুরী জাফরউল্লাহ শরাফাতের সেই আবেগ কণ্ঠে একজন ভবিষ্যৎ ফাস্ট বোলিং অলরাউন্ডার খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। এরপরই না চিত্রনাট্যের শ্রেষ্ঠাংশের প্রথম দৃশ্যের শুরু! মাত্র ১০ রানের টার্গেট, সেই ১০ রানেই ফ্লাওয়ার ভাইদের স্ট্যাম্প উড়িয়ে জানান দেওয়া– আমি সবাইকে দেখাতে এসেছি বাঙালির এই প্রজম্নের সাহস কতটুকু, কী করে সকল প্রতিকূলতাকে উড়িয়ে দিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে হয়, লক্ষ্য অর্জনের পথে দৃপ্ত পায়ে হাঁটতে হয়।

মাশরাফি কে? তার সবচেয়ে ভাল উত্তর জানা আছে সৌরভ গাঙ্গুলি— রাহুল দ্রাবিড় আর রবি শাস্ত্রির। মনে পড়ে কি, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের একশত ওয়ানডেতে ভারতকে হারিয়েছিল কে? মাশরাফি (৩২ রান, ২ উইকেট ও ২ ক্যাচ)।

মনে পড়ে ২০০৬ সালে যখন কেনিয়ার মত টিমের সাথে ১৯০ রান তাড়া করতে গিয়ে ১২০ রানেই ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পড় সেখান থেকে ৪৩ রান করে কিভাবে দলকে ম্যাচ জিতিয়ে সত্যিকারের নায়কের মতো মাঠ থেকে ফিরেছিলেন। মনে কি পড়ে না তার কথা, যে ২০০৭ বিশ্বকাপে হুঙ্কার ছুড়েছিল ভারতকে ‘ধরে দেবানি’ বলে? পরের কাহিনীতো রূপকথার মতো। ঐ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর ম্যাচের নায়ক যদি আশরাফুল হয় তবে তার নায়ক হওয়া সম্ভব হয়েছিল সেদিন ব্যাটিংয়ে মাশরাফি আর আফতাবের যোগ্য সঙ্গের কারণেই।

রবি শাস্ত্রির আপসোসের কথা কি মনে আছে সবার? ২০০৭ এর বিশ্বকাপে পরাজয়ের পর ভারতীয় ক্রিকেট টিমের বাংলাদেশ সফরে থিংক ট্যাংকের দায়িত্ব দেওয়া হয় রবি শাস্ত্রিকে। কৌশলী শাস্ত্রি ঢাকা ও চট্টগ্রামের আবহাওয়ার সাথে মিল থাকায় ভারতীয় টিমকে কলকাতায় দেড় মাস কন্ডিশনিং ক্যাম্প করিয়ে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্টে নামলো। সে টেস্টে ফলোঅন এড়িয়ে বাংলাদেশ ম্যাচ ড্র করেছিল শাহাদাৎকে নিয়ে মাশরাফির নায়কোচিত ব্যাটিংয়ের কারণে। পুরস্কার সরূপ ম্যাশ হলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। কিন্তু তার চেয়ে বড় পুরস্কারতো ছিল রবি শাস্ত্রির হাহাকার, ‘আহ! আমাদের যদি একজন মাশরাফি থাকত!’

এখনও পর্যন্ত আইসিসির টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন ২০১৫ বিশ্বকাপের কথা নাই বললাম। আজ বাঙালি ইমরান খান ও সেহবাগদের মুখের উপর বলে দিতে পারে— আমরাও সমান সমান, র‍্যাংকিংয়ে পাকিস্তানের উপরে, ভারতকে বলে— কয়ে সিরিজ হারায়া দিয়েছি। অথচ ২০১৪ সালের দিকে তাকালেই বুঝা যায় মাশরাফি নামক বটবৃক্ষের ছায়া পাবার আগে দলের অবস্থা কী ছিল, কোথায় ছিলাম আমরা, আফগানিস্তানও আমাদের কত বড় জু জু ছিল। সেখান থেকে আজ বাংলাদেশ র‍্যাংকিংয়ে ৬ নম্বরে। ২০১৫ এর বিশ্ব কাপের পর ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়। এরপর সামান্য ছন্দপতন হলেও আবার মাশরাফির নেতৃত্বে দিনের পর দিন কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা।

আমি ঘরোয়া ক্রিকেটের কথা আনতে চাই না। শুধু যদি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের কথাই বলি— তাহলে কুমিল্লার বাইরের মানুষ কুমিল্লাকে সমথর্ন দিয়েছিল শুধু মাশরাফি নামক আবেগ আর ভালবাসার কারণে। যে মাশরাফি আমাদের আবেগ, আমাদের ভালবাসার আর স্বপ্নের নায়ক স্বীকার করতে লজ্জা নেই যা দেয়ার ছিল তার শতভাগ তিনি দিতে পারেন নি। কিন্তু কেন? তার মূল কারণগুলোই বা কী ছিল? আমরা সেসব জানতে চাই না বা অনেকের বিরাগভাজন হবো বলে আলোচনাই করি না। শুধু আবেগে মাশরাফির বীরত্বের কথা বলি আর তার সাথে দুই এক ফোঁটা চোখের জল ফেলি।

আমি আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের পরিকল্পনার কিছু অসঙ্গতি, মাশরাফির প্রতি জুলুম আর অবিচারের কথা বলি—
বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ নিউজিল্যান্ড সফর, ২০০১ সালের ডিসেম্বরে হ্যামিলটনের কুইন্স পার্ক গ্রাউন্ডে সিরিজের প্রথম টেস্ট। বৃষ্টিতে প্রথম দুইদিন নেই। টসে জিতে বাশার বল তুলে দিলেন ম্যাশ আর তারই অনূর্ধ্ব— ১৭ দলের এক সময়ের সতীর্থ মো. শরিফের হাতে। ৩০ রানে নিউজিল্যান্ডের ৩ উইকেট নেই, ৫১ রানে নেই ৪টি। কে নিয়েছে? মাশরাফি (৩টি)। যদিও তখনকার বাংলাদেশ টিম ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আড়াই দিনেই ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল ম্যাচটি। যাহোক, দিনের খেলা শেষে হওয়ার আগেই মাঠের বাইরে মাশারাফি। কেন? ডান হাঁটুর পিছনের পেশিতে টান পড়েছে এবং হাঁটুতে সামান্য ব্যাথা। যদিও পরে মাঠে ফিরে এসে বল করেছিলেন কিন্তু ছন্দে ফিরতে পারেননি। মাশরাফি তার ব্যাথার কথা তৎকালীন অধিনায়ক বাশার ও টিম ম্যানেজারকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা!

তাছাড়া একেবারে নবীন মাশরাফির জোর গলায় না খেলার কথা বলার সাহস ছিল না। বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডে কত পণ্ডিতেরই তো আগমন ঘটেছে। তখনকার ক্রিকেট পণ্ডিত বিসিবির সভাপতি ফজলুর রহমান পটল ও টিম ম্যানেজম্যান্টের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে পায়ে ব্যাথা নিয়েও দ্বিতীয় টেস্টে খেলে গেছেন। এটাতো একজন নবীন খেলোয়াড়ের জন্য অবশ্যই জুলুমের বিষয়, তাই নয় কি। দ্বিতীয় টেস্টের খেলা চলছে আবারও সেই ব্যাথা, আবারও মাঠের বাইরে ম্যাশ। এবার ফিরে কী করে? যদিও তখন ততটা বোঝা গেল না যতটা বোঝা গেল ২০০৩ বিশ্বকাপে। এবার ২ ম্যচ খেলারর পরই সেই পুরোনো ইনজুরি। এক্সরে, এমআরআই রিপোর্ট দেখে ফিজিও (জন গ্লস্টার) জানিয়ে দিলেন, ‘এই অবস্থায় আর একটি বলও করলে আর কোনো দিন বল করা হবে না তোমার।’ অতপর মাশরাফির দেশে প্রত্যাবর্তন।

এবার একটা জোকস বলি— ফেরত এলো ম্যাশ (একজন ফাস্ট বোলার), বদলি খেলোয়াড় কে জানেন? আকরাম খান, যিনি একজন পিউর ব্যাটসম্যান। (Shame! Shame on BCB!)। জোকস আরও আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম কান্না মুলতান টেস্টে ইনজুরির অজুহাতে মাশরাফিকে একাদশের বাইরে রাখা হয়। অথচ দ্বাদশ খেলোয়াড় কে জানেন? মাশরাফি। শুধু তাই নয় ওই ম্যাচে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ফিলডিং করে অতিরিক্ত খেলোয়াড় হিসেবে রেকর্ড ৩টি ক্যাচও নিয়েছিলেন তিনি। ইনজুরিগ্রস্ত খেলোয়াড় দ্বাদশ খেলোয়াড় হয় কী করে? দীর্ঘ সময় মাঠে ফিল্ডিংই বা করে কী করে যদি তার ইনজুরিই থাকে। এটা কি তার প্রতি অবিচার ছিল না?

এবার আসি সিডন্স যুগে। অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ, সামনে ২০১১ বিশ্বকাপ। দলকে নিয়ে নানান কৌশলী প্র্যাকটিস, পরিকল্পনা। ইনজুরি থেকে সেড়ে উঠতে ম্যাশের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। ম্যাশ ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করলেন ঘরের মাঠের বিশ্বকাপের জন্য, দেশের জন্য। লাভ হল না, সিডন্স কাকু আর বিজ্ঞ ক্রিকেট কর্তাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল মাশরাফির আশি ভাগের উপর ফিট না থাকলে বিশ্বকাপের দলে তাকে বিবেচনা করা হবে না। কিন্তু মাশরাফি কি বলেছিল মনে আছে? — ‘আমি বিশ্বকাপে খেলার মতো ফিট আছি।’ আর মিরপুর স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে তার সেই কান্নার কথা নাইবা বললাম। কারণ আমাদের চোখে তা আজও ভাসে, যেমন ভাসে ২০১৫ এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর মাথায় জাতীয় পতাকা পেঁচিয়ে মাইক্রোফোন হাতে সেই মহানায়কের ছবি।

জানি নিয়ম মেনে একদিন তাকেও দল ছাড়তে হবে। বয়স তো ৩৩ বছর। ২০১৯ বিশ্বকাপ হয়তো আর খেলা হবে না, সামনের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলারতো প্রশ্নই উঠে না। তবে কি মাশরাফি খালি হাতেই ফিরবে? যে এত কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে, কোথাও কোথাও জুলুম ও অবিচার সহ্য করে ক্রিকেট ও দেশকে ভালবেসে মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন দেখালেন, বিশ্ব মঞ্চে বীরের রূপে আমাদের তুলে ধরার প্রয়াসে নেতৃত্ব দিলেন। আমরা তো ভালবাসা আর শুভ কামনা ছাড়া তাকে কিছুই দিতে পারবো না। তাই আমার প্রজন্মের বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্য, সবার প্রিয় পাগলা মাশরাফির জন্য কেউ না বলুক, আমি বলবই—
#PlayforMashrafe
একটি জয়= স্বপ্নপূরণ…
দুটি জয়= নতুন ইতিহাস…
আসুন, প্রিয় অধিনায়ক মাশরাফির প্রতি সম্মান এবং জাতীয় দলের প্রতি আমাদের শুভকামনা আর ভালোবাসা পৌঁছে দেই ইংল্যান্ডে।
আর বলি
#PLAYFORMASH

লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক