রাজধানীতে এডিস মশা নিধনে কেন এই ব্যর্থতা

ঢাকার মিরপুরের একজন বাসিন্দা রোখসানা আক্তার সম্প্রতি আরও অনেকের মতোই ব্যাপক মশা আতংকে ভুগছেন।

তিনি বলছেন, “খুব ভয় পাচ্ছি যে কখন আমি আবার জ্বরে আক্রান্ত হবো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে খুব ভয়ে আছি। মশার ওষুধ স্প্রে করছি, কয়েল জ্বালাই। তাতেও মশা মানে না। মনে হয় যে দিনে রাতে সবসময়ই মশারি ব্যবহার করি। মশারী টাঙিয়ে তার নিচেই শুয়ে থাকি।”

চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিলো রোখসানা আক্তারের সাথে। তার এই ভয়ের মূল উৎস এডিস মশা এবং এই মশার ছড়ানো রোগ ডেঙ্গু। তিনি বলছেন তার এলাকায় ফগার মেশিন নিয়ে কীটনাশক ছিটানোর শব্দ ইদানীং সবে কানে আসতে শুরু করেছে। এর বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে আর কোন কর্মকাণ্ড সারা বছর তার চোখে পড়েনি।

বছরব্যাপী মশা নিধন কর্মকাণ্ডের অভাব সম্পর্কে রোখসানা আক্তার যে অভিযোগ করছিলেন, কাছাকাছি সময়ে অনেকেই এই একই অভিযোগ করছেন। এছাড়াও অভিযোগ উঠেছে এডিস মশা নিধনে সঠিক কীটনাশক ব্যবহার করছে না সিটি কর্পোরেশনগুলো।

ঢাকায় শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এস এম মিজানুর রহমান বলছেন, দীর্ঘদিন একই কীটনাশক ব্যবহার করলে মশা তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়ে ওঠে।

“ঢাকায় বর্তমানে যে কীটনাশকগুলো মশার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, বছরের পর বছর এগুলো ব্যবহার করার ফলে এই ওষুধের বিরুদ্ধে কিউলেক্স মশা হোক বা এডিস হোক, এগুলো প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। মশা যদি কোন কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে পরিবর্তিতে তাদের বংশধরদের আগের পুরনো একই কীটনাশক দিয়ে রোধ করা কিন্তু সত্যিই কঠিন।”

অধ্যাপক রহমান বলছেন, এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধি ও এর দ্বারা ছড়ানো রোগ ডেঙ্গু এই বছর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটি।

আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে এখন হিমশিম খাচ্ছে ঢাকার বহু হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে শুধু জুলাই মাসেই ১৫ হাজার ৬শর বেশি ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে। শুধু আগস্টের এক তারিখেই নতুন করে ১৭শর বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা নথিভুক্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকা ছেড়ে এখন ঢাকার বাইরেও প্রায় সবগুলো জেলায় ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে। সারাদেশ ব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীদের সংখ্যা হিসেব করে এমন তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এখনো পর্যন্ত ঢাকাতেই এর প্রকোপ সবচাইতে মারাত্মক। ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে গেলেই এর ভয়াবহতা চোখে পড়ে। হাসপাতালগুলোর বারান্দায় ওয়ার্ডে সারি সারি শুয়ে থাকা ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা করেই চেনা যায়। কারণ মশারীর ভেতরে রাখা হয়েছে তাদের এবং এরকম অসংখ্য রোগী এখানে এসেছেন।

বহির্বিভাগে গিয়ে জানতে পারলাম সেখানেও অন্য সময়ের তুলনায় মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকেই আতংকিত হয়ে এখানে আসতে শুরু করেছেন। এখানে আসা লোকজন বলছেন, মশা যে মানুষকে এত ভয়াবহ একটি অসুখের সম্মুখীন করে তুলতে পারে তা তারা সেভাবে জানতেনই না।

যেমন খাদিজা বেগম। গত বুধবার থেকে তার ভাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে হাসপাতালে দিন কাটছে তার।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে এডিস মশা ও ডেঙ্গু সম্পর্কে তিনি কতটা চিন্তিত ছিলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে খাদিজা বেগম বলেন,”এখানে ভর্তি হওয়ার আগে অতটা দেখি নাই। ভর্তি হওয়ার পরে দেখি লোকজন মারা যাচ্ছে। অনেকে সিট পাচ্ছে না। রোগী সব জায়গায় ভর্তি।”

তিনি বলছেন, “শুনেছি যে মশায় কামড় দিলে নাকি ডেঙ্গু হয়। এই বছর ডেঙ্গু অনেক ছড়াইছে কারণ গত বছর কম বেশি কিছু হইলেও ওষুধ দিছিলো। কিন্তু এই বছর সেইরকম এত ওষুধ দেয় নাই।”

ঢাকার আদাবর বাজার এলাকার বাসিন্দা খাদিজা বেগম। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মশারীর নিচে শুয়ে ছিলেন তার ভাই। পাশেই ঘুমন্ত ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন খাদিজা বেগম। কাছেই মশারী টাঙানো এরকম আরো অনেক বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা।

ডেঙ্গু ভয়াবহ আকারে পৌঁছানোর পরই ইদানীং সিটি কর্পোরেশনগুলো তাদের কার্যক্রম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক এস এম মিজানুর রহমান মনে করেন এখন মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু কীটনাশক নিয়ে ভাবলেই চলবে না। তিনি বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর আবহাওয়া যেভাবে উষ্ণ হচ্ছে, বৃষ্টির মৌসুম যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তার সাথে এডিস মশা সহ নানা কীট পতঙ্গ বেড়ে যাওয়ার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

অধ্যাপক রহমান বলছেন, এসব পরিবর্তন সম্পর্কে দূরদর্শী হতে ব্যর্থ হয়েছে নগর কর্তৃপক্ষ। তার ভাষায়, “বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে, উষ্ণমণ্ডলীয় এবং অব-উষ্ণমণ্ডলীয় যেসব পোকামাকড় তাদের প্রাদুর্ভাব কিন্তু ধীর ধীরে বাড়ছে। অর্থাৎ গরমের সময়টা যদি দীর্ঘ হয়, তাহলে মশা বা কীটের জীবনকালে পরিবর্তন আসে। তার প্রজনন-কালীন সময় দীর্ঘ হচ্ছে। তাছাড়া ইদানীং বৃষ্টিপাত অনেক আগেই শুরু হয়। বর্ষা যত দীর্ঘ হচ্ছে মশার প্রজনন-কালীন সময় ব্যাপক দীর্ঘ হচ্ছে। তারা আরও বেশী প্রজনন সক্ষম হয়ে উঠছে।”

মশা নিয়ন্ত্রণে আপাতত জরুরী ভিত্তিতে স্বল্পকালীন ব্যবস্থা নেয়ার পর ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে বলে মত দিচ্ছেন অধ্যাপক রহমান।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে তাদের করা এক জরীপে দেখা যাচ্ছে বর্ষা শুরুর আগে ঢাকা শহরে প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশার সংখ্যা যা ছিল, বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর তা ছয়গুণ বেড়ে গেছে। মশার লার্ভা বা শূককীটের পরিমাণও অনেক বেশি পাওয়া গেছে। আর মূলত এ কারণেই ডেঙ্গুর এত প্রাদুর্ভাব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলছেন এই বিষয়ে তারা আগেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে সাবধান করেছিলেন। তিনি বলছেন, “আমাদের কাজ হল চিকিৎসা করা। মশা মারার কাজ আমাদের নয়। কিন্তু যদি মানুষের রোগবালাই বেশি সংখ্যায় হয় সেই বোঝাটা কিন্তু আমাদের বহন করতে হয়। সেজন্যেই বর্ষার পূর্বে, বর্ষার সময় ও বর্ষার পরে বিশেষ করে ঢাকা শহরে মশার পরিস্থিতি কী এই বিষয়ে আমরা জরিপ চালাই। বর্ষার পূর্বে মার্চ মাসে আমরা যে জরিপটি করেছিলাম সেই জরিপে আমরা দেখতে পেয়েছি যে মার্চে যে পরিমাণ মশা বা মশার লার্ভা আছে তাতে বর্ষা আসলে সেই সংখ্যাটি বাড়তে পারে। আমরা সাধারণত সিটি কর্পোরেশনকে জানানোর জন্যেই এই ধরনের জরিপ পরিচালনা করি।” ডা: আজাদ বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই এই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়েছে।

সিটি কর্পোরেশনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। ২০০০ সালের পর এই বছরই ডেঙ্গুর সবচাইতে বড় প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর পর থেকে প্রতিবছরই এটি কিছুটা দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সময়কাল দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার সিটি কর্পোরেশনগুলো সময়মত পদক্ষেপ নেয়নি বলে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। কীটনাশক ক্রয় ও ব্যবহারে দুর্নীতির অভিযোগ এমনকি তাদের কারিগরি সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, মশক নিধনে গত অর্থবছর তাদের বাজেট ছিল ১৮ কোটি টাকা। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেটও কাছাকাছি। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা কীটনাশক কিনছেন। অভিযোগ উঠেছে এডিস মশা নিধনে সেই ওষুধ আর কার্যকর নয় জেনেও কিছু করেনি তারা।

এসব অভিযোগের জবাবে ঢাকা উত্তরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মমিনুর রহমান মামুন বলছেন, “ভুল বা অকার্যকর কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযোগ একেবারেই সঠিক নয়। যখন কীটনাশক আমরা রিসিভ করি তখন আমরা ফিল্ড টেস্ট করি। সেটা করার পর যদি আমরা সন্তুষ্ট হই তখন আমরা ল্যাব টেস্টে পাঠাই। এটা কোন কোন মশার উপর কাজ করে সেটি আবার দেখা হয়। এসব করার পরেই কিন্তু কীটনাশকগুলো রিসিভ করি। যখন ল্যাব টেস্ট বা ফিল্ড টেস্ট সবই যখন ভালো হচ্ছে তখন আমার অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন কারণ নাই।”

তিনি বলছেন, মশা নিধন কার্যক্রম সারা বছরই চলে। এই মৌসুমে যে ধরনের পূর্বাভাস তাদের দেয়া হয়েছে সেই অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তবুও এডিশ মশার উপদ্রব ভয়াবহ আকারে দেখা যাচ্ছে।

এক্ষেত্রে কার দায়িত্ব কতটা ছিলো সে নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও সিটি কর্পোরেশনগুলো একে অপরকে দোষারোপ করছে। মমিনুর রহমান বলছেন তাদের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। কর্মী সংখ্যাও সাময়িকভাবে বাড়ানো হয়েছে। একবারের বদলে দুবার করে ফগার মেশিন দিয়ে কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে। নতুন ধরনের কীটনাশক আনার ব্যাপারেও কথাবার্তা চলছে।

কিন্তু এসব উদ্যোগ যে বড্ড দেরিতে নেয়া হয়েছে, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে গেলেই সেটি বোঝা যায়।