রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনিয়ন্ত্রিত জন্ম : অর্থনীতিতে প্রভাবের আশঙ্কা

মিয়ানমার সামরিক জান্তার দমন-নিপীড়ন, খুন, ধষণসহ নানা অত্যাচার-উৎপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফের ১২ অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। সরকার ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা রোহিঙ্গাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, পয়োনিস্কাশনসহ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। কিন্তু ক্যাম্পে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু না হওয়ায় রোহিঙ্গা জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদরা।

শনিবার উখিয়ার থাইংখালী জামতলি, তাজনিমার খোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে কর্মরত অবস্থায় দেখা গেছে বেশির ভাগ মহিলা গর্ভবতী। বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তারা জন্মনিযন্ত্রণ সম্পর্কে কিছ্ ুজানে না। এ ব্যাপারে আলাপও করতে চান না তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে রোহিঙ্গা মাঝি হামিদ হোসেন জানান, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করলেও তারা ছিল অনেকটা নজরবন্দি। বর্মি সামরিক জান্তারা রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে তাদের ফায়দা লুটেছে। রাখাইনে জন্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যসেবা দূরের কথা, রোহিঙ্গারা ঠিকমতো খাবার খেতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার।

রোহিঙ্গা মাঝি এনায়েত উল্লাহ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, রাখাইনে কোনো মানুষ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তাকে চোরাইপথে বাংলাদেশে এনে চিকিৎসা দিতে হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্বন্ধে রোহিঙ্গা মহিলারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তারা জানে না ওষুধ খেলে গভৃবতী হওয়া রোধ করা যায়। আবার অনেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে একের পর এক সন্তান ধারণ করছে। যে কারণে একেকটি পরিবারে ১০-১২ জন সদস্য।

কুতুপালং ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, ব্র্যাক, ইউনিসেফ, সেইভ দ্য সিলড্রেন, এসিএফ, এমএসএফ হল্যান্ডসহ ৭০টির বেশি এনজিও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের ধারণা দেওয়া হচ্ছে কি না- কয়েকজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

ময়নারঘোনা ক্যাম্পে এই প্রতিনিধির কথা হয় গর্ভবতী মহিলা আনোয়ার খাতুনের (২৮) সঙ্গে। তার স্বামীকে যখন গলা কেটে হত্যা করে বর্মি সেনারা, তখনও তিনি গর্ভবতী ছিলেন। তার আরো চারটি সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে কুলসুমার বয়স আট বছর। এত কম সময়ে চার সন্তান জন্ম দিলেন কেন জানতে চাইলে আনোয়ারা খাতুন লজ্জায় মুখ ঢেকে বস্তিতে ঢুকে পড়েন।

এ সময় পাশেই চিকিৎসা কেন্দ্র ব্র্যাকের এক মহিলা কর্মী সাজেদা বেগম জানান, রোহিঙ্গা মহিলারা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করে না। সন্তান জন্ম দেওয়া বন্ধ করলে নাকি পাপ হবে। এ অজ্ঞতার কারণে ক্যাম্পের প্রায় প্রতিটি ঘরে গর্ভবতী মহিলা রয়েছে বলে জানান জানায় রোহিঙ্গারা।

আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা সেইভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, প্রতিদিন ক্যাম্পে অন্তত ১৩০ জন শিশু জন্ম নেবে। সেই হিসেবে বছরে ৫০ হাজার শিশু জন্ম নেওয়ার ধারণা করা হচ্ছে।

এভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে তা স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন উখিয়া বিশ^বিদ্যালয় কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আহমদ ফারুক। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রতি বছর জমির পরিমাণ কমছে। সীমিত সম্পদ। দেশের জনসংখ্যা উপরে আরো ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখানে বসবাস করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর ৫০ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাতে ভবিষ্যতে খাদ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।’

খাধ্যে প্রভাবের আশঙ্কা করেন উপজেলা কৃষি অফিসার শরিফুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘এখানে উৎপাদিত ফসল স্থানীয়ভাবে চাহিদা পূরণ করছে। বরং খাদ্য ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গার চাপে খাদ্যের ওপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তবে সরকার এ ব্যাপারে সচেতন বলে জানান তিনি।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনার লোকজন রয়েছেন বলে দাবি করেন কর্মকর্তা মশিউর রহমান। তবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কর্মীসংখ্যা নগণ্য। সেজন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে হয়তো তাদের দেখা হয়নি।’

তবে অসংখ্য রোহিঙ্গা এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বা কর্মীর দেখা মেলেনি।

গত ২৪ আগস্ট থেকে এখন পর‌্যন্ত সরকারি হিসাবে সাড়ে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময় দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে।