সামরিক মহড়া: পরবর্তী মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়া?

তিন লাখ সৈন্য, এক হাজারেরও বেশি উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার ও মনুষ্যবিহীন আকাশযান, এবং ৮০ টি নৌযান নিয়ে রাশিয়া ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সামরিক মহড়ায় তাদের শক্তি প্রদর্শন করছে।

১-৮ সেপ্টেম্বর ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সামরিক মহড়া চালানোর পর মঙ্গলবার থেকে শুরু হয় ‘ভস্টক ২০১৮’ সামরিক মহড়া।
বিশাল আকারের সামরিক মহড়ায় চীন ও মঙ্গোলিয়ার সেনাদলও অংশ নেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও এতে উপস্থিত ছিলেন। রাশিয়ার পূর্বদিকে এই মহড়া চলছে।

রুশ সামরিক পর্যবেক্ষক পাভেল ফেল্গেনহাওয়ার তুরস্কের আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ‘রুশ কর্তৃপক্ষ সুনিশ্চিত যে ২০২০ সালের পর বসবাসের জায়গার জন্য লড়াই নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাবে। ২০২০ সাল পর্যন্ত রুশ ফেডারেশনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় এটা প্রতিফলিত হয়েছে’।

তিনি বলেন, ‘প্রথমে, এটা হবে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের জন্য লড়াই এবং রাশিয়ার এগুলো প্রচুর পরিমাণে আছে। একারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন দেশটিকে সব দিক থেকে আক্রমণ করা হবে। তাই সব ধরনের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা হয়েছে।’

ফেল্গেনহাওয়ার জানান, ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেন দখল করার পর থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছে।

‘২০১৫ সালে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাদের যুদ্ধের সক্ষমতা কম,’ বলেন ফেল্গেনহাওয়ার।

‘এরপর রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে পুনরায় অস্ত্রসজ্জিত করা এবং প্রশিক্ষণ দেয়ার বিশাল কার্যক্রম শুরু হয়। ভস্টক-২০১৮ ওই প্রস্তুতিরই শেষ ধাপ,’ মন্তব্য করেন তিনি।

ফেল্গেনহাওয়ার জোর দিয়ে বলেন, সিরিয়ায় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের সম্ভাবনা খুব বেশি হওয়ায় এই অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

“আমি বলছিনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। কিন্তু যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হয়ত এটা ‘কোল্ড ওয়ার’ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধের মতো হবে। ওই যুদ্ধ কেবল ইউরোপের ভূমিতেই ‘ঠাণ্ডা’ হয়ে ছিল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ায় তখন চলছিল ভয়ংকর সামরিক যুদ্ধ,” বলেন তিনি।

ফেল্গেনহাওয়ার আরও বলেন, যুদ্ধ প্রতিরোধ করার একটা উপায় হচ্ছে সম্ভাব্য শত্রুকে আপনার সক্ষমতার মাত্রা প্রদর্শন করা।

সামরিক বিশ্লেষক সের্গেই ইশ্চেঙ্কোর মতে, রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে সম্ভাব্য সম্মুখ যুদ্ধ এড়ানো।

তিনি বলেন, একারণে মস্কো ন্যাটো দেশগুলোর সীমান্ত থেকে দূরে এই বিশাল মহড়ার আয়োজন করেছে।

ইশ্চেঙ্কো আরও মনে করেন, রাশিয়া এই মহড়ার আয়োজন করেছে তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য।

রাশিয়ান কাউন্সিল অন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিশেষজ্ঞ আন্তন মারদাসভ মহড়ায় রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণের ব্যাপকতার কথা মনে করিয়ে দেন।

‘রুশ ফেডারেশনের সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় ১,৯০২,৭৫৮ জন সদস্য রয়েছে, যার মধ্যে ১,০১৩,৬২৮ জন সৈন্য। অর্থাৎ, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ সদস্য এই মহড়ায় অংশ নিবে,’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ।

মারদাসভের মতে, সেনাবাহিনীকে কার্যকর অবস্থায় রাখতে এটিকে ব্যস্ত রাখতে হয়।

‘যুদ্ধ না থাকলে সামরিক মহড়া তার জায়গা নেয়। মহড়া যত বড় হবে, সেনাবাহিনীকে তত বেশি কাজ করতে হবে, এবং এসব করার সময় তাদের যোগ্যতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়,’ বলেন তিনি।

তুরস্কের মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ওকটে তানরিসেভার এই মহড়াকে ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ ঘটনা বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন, গত ৩-৪ বছর ধরে রাশিয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও দেশটির পশ্চিম প্রান্তে বড় ধরনের সামরিক মহড়ার আয়োজন করে আসছে।

‘কিন্তু এবারই প্রথম তারা দেশের পূর্ব দিকে বড় ধরনের সামরিক অনুশীলনের আয়োজন করল। রাশিয়া বড় ধরনের সামরিক বাধা মোকাবেলায় সক্ষম, তা দেখাতেই এই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে,’ বলেন তানরিসেভার।

তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং ক্রিমিয়া দখল করার পর থেকেই ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটে।

‘একারণে তারা গত চার বছরে বিভিন্ন সামরিক মহড়ার আয়োজন করেছে,’ বলেন তানরিসেভার।

তার মতে, রাশিয়া সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সেটা দেখানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। রাশিয়া বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে এই বার্তা দেয়াই তাদের উদ্দেশ্য।

তিনি আরও বলেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্রিটিশ ও মার্কিন নৌবাহিনীর সেনা মোতায়েন করায় রাশিয়া উদ্বিগ্ন। তাই তারা সেখানে ছোট আকারে একটা সামরিক মহড়া চালিয়েছে।

‘কিন্তু ভূমধ্যসাগরের ওই মহড়াও ভস্টকে চলমান সামরিক অনুশীলনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ,’ জোর দিয়ে বলেন তানরিসেভার, ‘কারণ, পূর্ব ভূমধ্যসাগর পৃথিবীর অন্যতম সংকটাপন্ন এলাকা’।

তানরিসেভার বলেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের রুশ সামরিক মহড়াতে রাশিয়ার বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক অভিসন্ধি প্রকাশ পেয়েছে।

‘এসব ঘটনাক্রম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহড়াগুলোকে সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরুর তৎপরতা বলে মনে করা উচিৎ হবে না। এটা কেবল শো বিজনেস বা প্রদর্শনী,’ যোগ করেন তিনি।