সিঙ্গাড়া বিক্রেতার সন্তানদের বিশ্ব জয়!

এক সিঙ্গাড়া, সমুচা বিক্রেতা বাবার গল্প বলছি। ভারতের উত্তরখান্ড প্রদেশের ঋষিকেশ অঞ্চলে স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার।

বড় মেয়ে যে কলেজে পড়ত, তার সামনেই ছোট্ট একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গারা, সমুচা বিক্রি করতেন দরিদ্র এই পিতা। মেয়ের কলেজের বন্ধুরা এটা নিয়ে মেয়েকে টিপ্পনি কাটত। কত দিন বড় মেয়ে কান্না লুকিয়ে বাড়ি ফিরেছে তার ইয়ত্তা নেই।

আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও এই পরিবারে একটি জিনিসের অভাব ছিল না। সেটি হলো সঙ্গীত। খেয়ে না খেয়ে পরিবারে তিন সন্তানই গানের চর্চা করত। বড় মেয়েটি তখনই কিছু কিছু মঞ্চ অনুষ্ঠানে গান গাইতে শুরু করে দিয়েছে। সবাই তার গান শুনে বলত, দেখো ঋষিকেশ, তোমার মেয়ে একদিন অনেক বড় সঙ্গীতশিল্পী হবে। এসব শুনে মনে মনে স্বপ্ন দেখতে থাকেন দরিদ্র পিতা।

ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এরপর পরিবারটি দিল্লি চলে গেল। দিল্লি গিয়ে পরিবারটি আরো অভাবে পড়ল। বাধ্য হয়ে বড় দুই ভাই-বোন দিল্লির পাড়ায় পাড়ায় জাগরণের গান গাইতে শুরু করল। ছোট মেয়ের বয়স যখন চার, তখন সেও জাগরণের গানে যোগ দিল। সারা রাত জেগে তিন ভাই-বোন গান গাইত। গান গাইতে গাইতে দম ফুয়িয়ে আসত। ছোট্ট ফুসফুসে এত চাপ সইতে কষ্ট হলেও দমে যায়নি সেই ছোট্ট মেয়েটি। ভাই-বোনের সাথে পাল্লা দিয়ে গান গাইতে লাগল। এত কষ্ট করে গান গাওয়ার পরও ধন্যবাদটাও ঠিকমতো জুটত না। পরের দিন স্কুলেও যাওয়া হতো না ছোট্ট মেয়েটির।

বড় মেয়েটির বয়স যখন ২৩, তখন হিন্দি ও তেলেগু ছবির বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সন্দিপ চৌতার নজরে আসেন। চলচ্চিত্রে প্রথম গান গেয়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে বড় মেয়েটি। এরপর আর পরিবারটিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরিবারে একমাত্র ছেলেটিও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বেশ নাম কুড়িয়ে ফেলেন।

২০০৬ সালে সিঙ্গারা, সমুচা বিক্রেতা বাবার ছোট মেয়েটি সঙ্গীতভিত্তিক রিয়েলিটি শো ইনডিয়ান আইডলে অংশগ্রহণ করে। সেটা ছিল ওই অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় আসর। মেয়েটির বয়স তখন সবে ১৭। মঞ্চে একের পর এক বিখ্যাত গানগুলো অবিকৃত সুরে গেয়ে তাক লাগিয়ে দেয় ছোট মেয়েটি। দর্শকরা এই মেয়েকে ভারতের শাকিরা ডাকতে শুরু করে।

সবাই যখন ধরেই নিয়েছে, এই মেয়েটি নিশ্চিতভাবে পড়তে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান আইডলের দ্বিতীয় আসরের মুকুট তখনই চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয় সে। এর পর দর্শকের ভোটে ইন্ডিয়ান আইডল থেকে ছিটকে পড়ে সে। এরপরও মেয়েটি দমে যায় না। ইন্ডিয়ান আইডল তাকে অনেক বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকের দৃষ্টিগোচর করে। ২০০৯ সালে ‘ব্লু’ ছবির থিম সংটি গাওয়ার মধ্যে দিয়ে তার হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক সিঙ্গারের ক্যারিয়ার শুরু হয়। এরপর যা হয়েছে সে তো ইতিহাস।

সিঙ্গাড়া, সমুচা বিক্রেতা বাবার পুরো নাম ঋষিকেশ কাক্কর। তার স্ত্রীর নাম নিতি কাক্কর। বড় মেয়ে শনু কাক্কর তার প্রথম প্লেব্যাক ‘দম’ নামের হিন্দি ছবিতে ‘বাবুজি’ গানটি গেয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রের দর্শক-শ্রোতাদের মাত করে দেয়। একমাত্র ছেলে টনি কাক্কর বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এবং সঙ্গীতশিল্পী। তার সাম্প্রতিক কম্পোজকৃত ও ছোট বোনের সাথে গাওয়া ‘মিলে হো’ গানটি উইটিউবে ১২ কোটির অধিকবার দেখা হয়েছে।

আর পরিবারের সবচেয়ে ছোট মেয়েটিই সবচেয়ে বেশি সুনাম কুড়িয়ে এনেছে কাক্কর পরিবারের জন্য। ছোট মেয়েটির নাম নেহা কাক্কর। ভারতের বর্তমান ফিমেল সিঙ্গার সেনসেশন। ২০০৬ সালে ইন্ডিয়ান আইডলের আসর থেকে দর্শকের ভোটে ছিটকে পড়া এই সঙ্গীতশিল্পী ভারতের আরেক বিখ্যাত সঙ্গীত বিষয়ক রিয়েলিটি শো ‘সারেগামাপা’ চলতি সিজন-৬ এর বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছে।

সমুচা বিক্রেতা বাবা যে কিনা সন্তানদের দুবেলা খাবার যোগার করতে গিয়েই হিমশিম খেতেন, তার তিন সন্তানই এখন ভারতসহ বিশ্ব মাতাচ্ছে। এজন্য বলে, মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়।