৭০ বছরেও পূর্ণ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী পেল না পাকিস্তান

ইতিহাস কি নিজে নিজেই পুনরাবৃত্তি হয়? ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে এর উত্তর হয়ত ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে ইতিহাস নিজে নিজেই পুনরাবৃত্তি হয়। তা না হলে ৭০ বছয় বয়সী একটি দেশ এখন পর্যন্ত কেন পাঁচ বছর মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী পাবে না?

১৯৪৭ সালের পর দেশটিতে একজন প্রধানমন্ত্রীও তার মেয়াদ পাঁচ বছর পূর্ণ করতে পারেননি। এই ইতিহাস ফের পুনরাবৃত্তি হয়েছে দেশটির সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বেলায়ও।

শুক্রবার পানামা কেলেঙ্কারির এক মামলার রায়ে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার অযোগ্য ঘোষণা করে। এই রায়ের পরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বলা হয়, কিছু বিষয়ে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

২০১৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ। এর আগের দুইবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান নওয়াজ।

প্রথমবার ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালেও দুর্নীতির দায়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় নওয়াজকে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক’ পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে দেশটি। চারবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সিংহাসনচ্যুত করে সামরিক স্বৈরশাসক। একজন প্রধানমন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন, একজনের আদালতের রায়ে ফাঁসি হয়েছে, অনেককেই প্রসিডেন্ট কর্তৃক বরখাস্ত করা হয়েছে। একজন আদালতের রায়ে বরখাস্ত হয়েছেন। সবশেষ আজ শুক্রবার আদালতের রায়ের পর পদ থেকে সরে গেলেন নওয়াজ শরিফ।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার ইতিহাস থেকে জানা যায়, দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে ১৯৫১ সালে হত্যা করা হয়। তিনি দেশ সৃষ্টির পরপরই দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দীন। দুই বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে তাকে বরখাস্ত করে গভর্নর গোলাম মুহাম্মদ।

এরপর প্রধানমন্ত্রী হন বগুড়ার মুহাম্মদ আলী, এক বছরের মাথায় তাকেও পদচ্যুত করেন গভর্নর গোলাম মুহাম্মদ। যদিও এর বিরুদ্ধে তিনি আদালতে যান। আদালতে তাকে ফের ক্ষমতায় ফেরার রায় দেন। তিনি পুনর্বহাল হয়েও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।

১৯৫৫ সালে গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মোহাম্মদ আলীকে পদচ্যুত করেন। কারণ সাংবিধানিক পরিষদে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মুহাম্মদ আলী। ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে কলহের জেরে তিনিও ১৯৫৬ সালে পদত্যাগ করেন।

এরপর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সোহরাওয়ার্দী হচ্ছেন মুসলিম লীগের বাইরে প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতা যিনি ১৯৫৬ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মত পার্থক্যের কারণে সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৭ সালে পদচ্যুত হন।

সোহরাওয়ার্দীর পদত্যাগের পর চন্দ্রিগড়ের ইব্রাহিম ইসমাইলকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন ইস্কান্দার মির্জা। তিনি দুইমাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এরপর ফিরোজ খান নূনকে পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে ফিরোজ খান নূনকে বরখাস্ত করেন আইয়ুব খান। সামরিক শাসনের ১৩ বছর পর ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ভুট্টো ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। ওই বছরই জেনারেল জিয়াউল হক ক্যু করে তাকে পদচ্যুত করেন। এরপর ১৯৭৯ সালে সামরিক আদালতে ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়া হয়।

১৯৮৫ সালে মুহাম্মদ খান স্বৈরাশাসকের অধীনে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৮ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হন বেনজীর ভুট্টো। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসাক খান ভুট্টোকে বরখাস্ত করেন।

১৯৯০ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসাক খান তাকে বরখাস্ত করেন। পরে আদালতে তাকে পুনর্বহাল করলেও সেনাপ্রধান ওহিদ কাকার নওয়াজ শরীফ এবং গোলাম ইসাক খান উভয়কেই একই বছরের ১৮ জুলাই পদচ্যুত করেন।

১৯৯৩ সাল ফের ক্ষমতায় আসেন বেনজীর ভুট্টো। এই সময়ে এসে তিনি তিন বছর ক্ষমতায় স্থায়ী হন। ১৯৯৬ সালে তার প্রতি অনুগত থাকা প্রেসিডেন্ট ফারুক লাঘারি ষড়যন্ত্র করে তাকে পদচ্যুত করেন।

১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ফের পাকিস্তারে প্রধানমন্ত্রী জন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ জরুরি অবস্থা জারি করে নওয়াজ শরীফকে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলেন। এরপর তিনজন প্রধানমন্ত্রী স্বৈরশাসক মোশাররফের অধীনে কাজ করেন।

এর মধ্যে জাফরুল্লা খান জামালি ১৯ মাস দায়িত্ব পালন করেন। চৌধুরী সুজাত ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মোশাররফের বন্ধু শওকত আজিজ ২০০৪ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন।

২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করায় ইউসূফ রাজা গিলানি দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। আদালত অবমাননার মামলায় তিনি সাজা পান। তিনি ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

পিপিপি সরকারের বাকি সময়ে দায়িত্ব পালন করেন রেজা পারভেজ আশরাফ। অর্থাৎ ২০১২ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এরপর তৃতীয় বারের মতো ২০১৩ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। মেয়াদের শেষ বছরে তিনি ফাঁসলেন পানামা পেপার কেলেঙ্কারিতে।

সর্বশেষ নওয়াজ শরিফরে উদাহরণের পর ইতিহাস ফের পুনরাবৃত্তি হল। দেশটির একজন প্রধানমন্ত্রীও পুরো সময় দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না।

‘ইন্টারন্যাশনাল দ্য নিউজ’ অবলম্বনে মহিউদ্দিন মাহী