৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালিত হয় যেভাবে

১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটি অন্য রকম করে পালিত হয়েছিল। সেদিন বাংলাদেশের শিল্পীরা অভিনব উপায়ে জানিয়ে দেন, তাদের স্বপ্নের স্বাধীনতার দাবি।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শেষে নেই ঘোষণার ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মানে বুঝতে বাকি ছিল না শিল্পীদের। আর এই ভাষণের পর ছবি ও পোস্টারের মাধ্যমে প্রকাশ্যেই স্বাধীনতাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরার জন্য তারা সবাই এক জোট হয়ে আলোচনায় বসলেন।

সিদ্ধান্ত হয়, ছবি এঁকে, পোস্টার ও বড় বড় ব্যানার লিখে বাঙালির এই অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীরকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হলো। ১০ দিন ধরে কয়েকশ ছবি ও পোস্টার এঁকে চিত্রশিল্পীরা ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শহীদ মিনার থেকে বিপ্লবী চিত্রের বিশাল এক অভিনব মিছিল বের করলেন।

প্রত্যেক শিল্পীর হাতে সেদিন ছিল একটি করে আঁকা চিত্র। আর এসব চিত্রের বিষয় হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের তথা বাঙালিদের বঞ্চনা, নির্যাতন, সম্পদ লুট করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের, বাংলার ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ ও অবহেলার ছবি, সেই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতিবাদ ও সংগ্রামের ছবি।

সে সময়ের মার্শাল ল-এর আইন অনুযায়ী এটা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এর জন্য দেখামাত্র গুলি করতে পারত সেনারা। কিন্তু চিত্রশিল্পীরা মৃত্যু হতে পারে জেনেই এই মিছিল বের করেছেন।

এই মিছিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল স্বাধীনতা। এই চারটি অক্ষর বড় বড় করে সুন্দরভাবে লিখে চারটি মেয়ে গলায় ঝুলিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে হেঁটেছিলেন মিছিলকারীরা।

এই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। সেদিন তিনিই ছিলেন শিল্পীদের সবচেয়ে বড় সাহস ও শক্তি। রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল এই চলমান প্রদর্শনী দেখার জন্য।

খবর পেয়ে বেগম সুফিয়া কামাল মিছিলে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পাশে থেকে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মিছিলটি শহীদ মিনার থেকে সেগুনবাগিচার তোপখানা রোড হয়ে বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে নবাবপুর রোড ধরে ভিক্টোরিয়া পার্ক বা বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত গিয়েছিল। তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা পুলিশ বাহিনী মিছিলে বাধা দেয়নি এবং গুলিও করেনি।

সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে হাজারো মানুষ যায় তাকে শুভেচ্ছা জানতে। তবে বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন, তিনি জন্মদিন পালন করেন না।

বাসভবনে পৌঁছানোর পর দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় মিলিত হন। জনৈক বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশের নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে জানতে চান ৫২তম জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় কামনা কি? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি’। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। আমার জন্ম দিনে মোমবাতি জ্বালাই না, কেকও কাটি না।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিন কী, আর মৃত্যু দিনও কী? আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু।’

তবে বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্ম দিন উপলক্ষে বায়তুল মোকারম মসজিদে আছর নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘায়ু কামনা করে মোনাজাত হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা শেখ মোহাম্মদ ওবায়দুরাহ বিন সায়িদ জালালাবাদী।

বঙ্গবন্ধুর পরের জন্মদিনটিতে অবশ্য এই ধরনের আর মিছিল বের করতে হয়নি। ততদিনে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। আর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে শুরু করে দেন দেশ গড়ার কাজও।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্ম নেয়া খোকার নেতৃত্বে সংগ্রাম আর পরে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। আজ সাড়ম্বরে সারা দেশে পালিত হচ্ছে দিনটি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসর পর থেকে দিবসটি জাতীয় শিশু দিবস হিসেবেও পালিত হয়ে আসছে।