মানুষের দ্রুত রেগে যাওয়ার কারণ কি?
বর্তমান পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের সিংহভাগই অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করে থাকে। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অনেক দেশেই দারিদ্রের হার কমছে এবং মানুষের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বাড়ছে।
মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে বসবাসকারী মানুষের অধিকাংশই অন্যান্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ জীবনযাপন করছে।
যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের আশেপাশের এত মানুষকে কেন সবসময় ক্রুদ্ধ, রাগান্বিত মনে হয়?
রাস্তায় চলাচল করার সময়, সামাজিক মাধ্যমে বা কোনো রাজনীতিবিদের সমালোচনা করার সময় মানুষের ক্ষোভ যেভাবে প্রকাশিত হয়, তা দেখে কেউ যদি ধারণা পোষণ করে যে পৃথিবীর মানুষ আসলে চিরস্থায়ী ক্রোধের মধ্যে ডুবে আছে – তাহলে তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না।
ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক অলিভার বার্কেম্যানের লেখালেখির বিষয়বস্তু হলো কীভাবে সুখের সন্ধান পাওয়া যায়। এই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তিনি ‘ক্রোধ’ বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
তিনি খুঁজে বের করতে চেয়েছেন যে আমরা কেন রেগে যাই? কোন বিষয়গুলো রাগ চড়িয়ে দেয়? অথবা, রাগ করা কি আসলে খারাপ?
প্রকৃতির সাথে মানুষের অভিযোজনের শুরুর দিকে, একজন ব্যক্তির আরেকজনের ওপর ক্রুদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা আসতো কীসের থেকে?
যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যারন সেল বলেন, ‘ক্রোধ খুবই জটিল একটি বিষয়।’
‘নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করলে বলা যায়, এটি মানুষের মন নিয়ন্ত্রিত একটি যন্ত্র। আরেকজন ব্যক্তির মাথার ভেতরে ঢুকে নিজেকে ঐ ব্যক্তির কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদ্ধতি। তাদের মন পরিবর্তন করে তাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার একটি প্রক্রিয়া।’
প্রফেসর সেল বলেন এই ‘মন নিয়ন্ত্রণের’ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে মানুষের ‘রাগান্বিত চেহারা।’
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, ক্রুদ্ধ হলে মানুষের ভ্রু বিস্তৃত হয়ে যাওয়া, নাসারন্ধ্র প্রসারিত হওয়া এবং চোয়ালের পুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার মত পরিবর্তনগুলো মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে – বলেন প্রফেসর সেল।
‘রাগ হলে মানুষের মুখের অভিব্যক্তিতে যেসব পরিবর্তন হয়, তার প্রত্যেকটির ফলেই মানুষকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী দেখায়।’
প্রফেসর সেল বলেন, এই বিষয়গুলো মানুষ শেখে না, বরং জন্মসূত্রে অর্জন করে কারণ ‘অন্ধ শিশুরাও একই ধরণের ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।’
আপনি এমনটা ধারণা করতেই পারেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যারা ক্রুদ্ধ হতো না এবং সংঘর্ষে জড়াতো না, তারা দ্রুত রেগে যাওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে বেশীদিন বাঁচত – তবে বিষয়টি আসলে সেরকম নয়।
প্রফেসর সেল বলেন, ‘একটি বিশেষ ধাঁচের রাগ যেসব মানুষের মধ্যে ছিল, তারা অন্যদের চেয়ে বেশী হারে বংশবৃদ্ধি করেছে।’
স্বার্থের সংঘাতে বিজয়ী হয়ে এবং আরো ভালো জীবনযাপনের লক্ষ্যে ক্রমাগত দর-কষাকষির মাধ্যমে তারা সেটি সম্ভব করেছে।
‘অতীতে, যেসব লোকের কোনো রাগ ছিল না তারা নিগৃহীত হতো’, বলেন প্রফেসর সেল।
অন্যান্যরা সেসব মানুষের সম্পদ চুরি করতো এবং তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতো এবং ‘ফলস্বরূপ তারা মারা যেতো।’
সেসব মানুষই টিকে ছিল যারা অন্যান্য সাধারণ মানুষকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিতো এবং নিজেদের গুণকীর্তন এমনভাবে অন্যদের বারবার মনে করিয়ে দিতো, যার ফলে অন্যান্য সাধারণ মানুষ তাদের সম্পর্কে ক্রমাগত উঁচু ধারণা পোষণ করতো এবং কৃতজ্ঞতা বোধ করতো – যে কারণে ঐসব ব্যক্তিদের সাথে ভালো ব্যবহার করতো।
প্রফেসর সেল বলেন, ক্রোধ ঐ ধরণের মানুষকে অভিযোজনে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।
ক্রোধকে বোঝার জন্য আমাদের ভাবতে হবে যে এটি আমাদের মধ্যে কী ধরণের শারীরিক পরিবর্তন ঘটায়, এর ফলে আমাদের আচরণে কী পরিবর্তন আসে, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমরা কী চিন্তা করি এবং কী চিন্তা করতে পারি না।
যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর রায়ান মার্টিন, যিনি ক্রোধ বিষয়ে গবেষণা করেন, বলেন রাগ হলে মানুষের সহানুভূতিশীল স্নায়ুবিক কার্যক্রম শুরু হয়।
‘রাগ হলে আপনার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে যায়, আপনি ঘামতে শুরু করবেন এবং পরিপাক ক্রিয়া ধীরগতিতে চলতে শুরু করে।’
মানুষ যখন মনে করে যে তার সাথে অবিচার করা হচ্ছে, তখন শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এধরণের উপসর্গ প্রকাশ পায়। একই সাথে মস্তিষ্কও ভিন্ন আচরণ করা শুরু করে।
‘মানুষ যখন তীব্রভাবে কিছু অনুভব করে, তখন চিন্তা ভাবনার অধিকাংশই ঐ একটি বিষয় কেন্দ্রিক হয়ে থাকে।’ তখন তারা ‘টিকে থাকা’ বা ‘প্রতিশোধ নেয়ার’ বিষয়টিকেই বেশী প্রাধান্য দেয়।
কোনো বিশেষ একটি অবিচার বা অন্যায়ের বিষয়ে চিন্তা করা বা তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার সময় অন্য কোনো বিষয় নিয়ে মানুষের মস্তিষ্ক চিন্তা করতে চায় না – এটিও অভিযোজনেরই অংশ।
আপাতদৃষ্টিতে, বর্তমান সময়ে উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ মানুষেরই তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সংগ্রাম করে জীবনযাপন করতে হয়।
প্রফেসর মার্টিন বলেন, ‘মানুষ আগের চেয়ে ব্যস্ত এবং তাদের জীবনে চাহিদা অনেক বেশী, কাজেই জীবনের উদ্যম কমে যাওয়ার পরিণাম চিন্তা করলে মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।’
সুপারমার্কেটে লাইনে দাঁড়ালে অথবা কোনো জরুরি সেবা নিতে গিয়ে অহেতুক অপেক্ষা করতে হলে আমরা অনেক দ্রুত রেগে যাই – কারণ আমাদের কাছে নষ্ট করার মত সময় নেই।
স্বাভাবিকভাবেই, যে ব্যক্তির ওপর আমরা রেগে থাকি, তাকে আরো বেশী আঘাত দিয়ে কোনো লাভ হবে না – কাজেই রাগ কমাতে আমাদের অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মায়া তামির বলেন, আমরা যতটুকু মনে করি, রাগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আমাদের তার চেয়ে বেশী ক্ষমতা রয়েছে।
মায়া বলেন, ‘যদি জন্মসূত্রে অর্জন করার পাশাপাশি আবেগ তৈরি করা এবং শেখা যায়, তাহলে ক্রোধের মত আবেগের ক্ষেত্রে সব মানুষ হয়তো একইরকম প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে না।’
মানুষ যদি তার ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থান ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ক্রোধকে ব্যবহার করে, তাহলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।
তবে মনোবিজ্ঞান এও বলে যে, ক্রোধের বশবর্তী না হয়ে মানুষ তার মনকে একীভূত করে তার বিরুদ্ধে হওয়া অবিচারের প্রতিক্রিয়া জানানোর সক্ষমতা রাখে।
দার্শনিক এবং মনোরোগ চিকিৎসক মার্ক ভারনন বলেন, প্লেটোনিক এবং অ্যারিস্টটলিয়ান চিন্তাধারায় ধারণা করা হতো যে `সঠিক ক্রোধ` বলে একটি বিষয় রয়েছে।
ক্রোধ যখন কাউকে ‘সাহসের সাথে একটি অবিচারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রেরণা দেয় অথবা গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ন্যায়বিচারের পটভূমি তৈরি করে দেয়’ – তখন সেই রাগকে ভালো না বলার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
তথ্যসূত্র : বিবিসি
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন