খালেদার কারাবাসে বিএনপিতে সাংগঠনিক স্থবিরতা

বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের বয়স আগামীকাল সোমবার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। বিগত সম্মেলনে দুটি নতুন বিধান সংযুক্তিসহ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। কিন্তু, দীর্ঘ দুই বছরেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিএনপি। এমনকি আজঅব্দি দলটি তাদের কমিটিগুলোও পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। এ অবস্থার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাসের ঘটনায় দলীয় কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, দলীয় প্রধানের মুক্তির পরই সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি আসবে।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল হয়। সেখানে ৫০২ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়। স্থায়ী কমিটির সদস্য ১৯ করা হলেও দু’জনের নাম ঘোষণা করা হয়নি। এরপর বিগত দুই বছরে দু’নেতার মৃত্যুতে স্থায়ী কমিটি দাঁড়িয়েছে ১৫ জনে।

এর বাইরে ছাত্র, সহ-ছাত্র, যুব ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে এখনো নেতা নির্বাচন করতে পারেনি বিএনপি। গণতন্ত্র অনুযায়ী, কমিটির মেয়াদ তিন বছর। দুই বছরেও যেসব পদে নেতৃত্ব আসেনি, বাকি সময়ে তা আসা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

কাউন্সিলের পর দুই বছর কেটে গেলেও দলীয় গঠনতন্ত্র বই আকারে প্রকাশ করতে পারেনি বিএনপি। ফলে নতুন কি সংশোধনী এলো, তা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানতে পারছেন না।

কাউন্সিলে বিষয়ভিত্তিক ২৬টি উপ-কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল। এসব কমিটির প্রতিটিতে ১২ জন সদস্য রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, এখনো সেটি হয়নি।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান। এরপর থেকে তিনি কারাবন্দি।

তবে কারাগারে যাওয়ার কয়েক দিন আগে বিএনপি তাদের সংশোধিত গণতন্ত্র নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেয়। নতুন গণতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বিলুপ্ত করার বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ৭ ধারা বাতিল নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করতেও ছাড়েননি। তারা বলেন, বিএনপি দুর্নীতিবাজদের নেতা বানাতেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বিলুপ্ত করেছে।

তবে বিএনপি নেতাদের দাবি, দেশের চলমান বাস্তবতা মেনেই দলীয় গণতন্ত্রে সংশোধনী আনা হয়েছে, যা কাউন্সিলে সদস্যদের সম্মতিতে পাস করা হয়।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি নতুন গঠনতন্ত্রের ১৩ ধারায় বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটি করার বিধান করেছে। দলের চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজন মনে করলে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে কয়েকজনের সমন্বয়ে বিষয়ভিত্তিক উপ-কমিটি করতে পারবেন।

যে সমস্ত বিষয়ে এ ধরনের উপ-কমিটি হতে পারে সেগুলো হচ্ছে- অর্থ ও পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, গবেষণা, আন্তর্জান্তিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা, শিল্প ও বাণিজ্য, নারী ও শিশু, বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, যুব উন্নয়ন, শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ, যোগাযোগ ও গনপরিবহন, এনার্জি ও খনিজ সম্পদ, মানবাধিকার, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পানি সম্পদ উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মুক্তিযুদ্ধ, ক্ষুদ্র ঋণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, সুশাসন ও জনপ্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, গণমাধ্যম, জাতীয় সংহতি ও এথনিক মাইনরিটি।

এ সমস্ত কমিটিতে দলের সদস্য নন অথচ বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী, যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।

গণতন্ত্রের ১৪ ধারায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণা কেন্দ্র ও মিডিয়া উইং সংযুক্ত করা হয়েছে। দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের অধীনে দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দানের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, দলের সামগ্রিক সামর্থ বৃদ্ধির জন্য একটি গবেষণা কেন্দ্র এবং ইলেক্ট্রনিক ও সামজিক মিডিয়ার মাধ্যমে দলের প্রচার কার্যক্রম জোরদার ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার লক্ষ্যে একটি মিডিয়া উইং প্রতিষ্ঠা করা হবে।

দলের চেয়ারম্যান স্বয়ং কিংবা তার মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে তিনি এসব বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি করবেন।

গণতন্ত্র সংশোধনে ১৫ ধারায় বিশেষ বিধান : এক নেতার এক পদ; ক) কোনো ব্যক্তি একই সাথে দলের জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন কিংবা ওয়ার্ড কমিটিতে সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হতে পারবেন না। খ) দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির কিংবা চেয়ার‌ম্যানের উপদেষ্টা কাউন্সিলের কোনো সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটির কোনো কর্মকর্তা এবং দলের অঙ্গদল কিংবা সহযোগী সংগঠনের কোনো সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদক দলের অন্য কোনো পর্যায়ের কমিটিতে কর্মকর্তা নির্বাচিত হতে পারবেন না। তবে অনিবার্য কারণে দলের চেয়ারম্যান সাময়িকভাবে ব্যতিক্রম অনুমোদন করতে পারবেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কমিটি পূর্ণাঙ্গের কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। ম্যাডাম কারাগারে থাকা এটি বর্তমানে স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি মুক্তি পাওয়ার পরই দ্রুত কমিটি দেয়া হবে।’

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার বলেন, ‘রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, এটা সত্য। তবে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। সরকার মিছিল-মিটিং করতে দিচ্ছে না। তারপরও কিন্তু কিছু জেলা কমিটির কাজ শেষ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের নেত্রী জেলে। এখন একটাই আন্দোলন তাকে মুক্ত করা। এজন্য অন্যান্য সাংগঠনিক কার্যক্রম আপাতত স্থগিত আছে। নেত্রীর মুক্তির পর আবার সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতি আসবে।’

একাধিক পদে আছেন যারা

ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি গৃহীত হয়। এরপর থেকে কয়েক দফায় পদক্ষেপ নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বাড়তি হিসেবে দফতরের দায়িত্ব পালন করছেন। একইভাবে ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি, যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার বরিশাল জেলা বিএনপির সভাপতি, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনও নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া হাবিব-উন নবী খান সোহেল দলের যুগ্ম মহাসচিব ছাড়াও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।-সৌজন্যে : পরিবর্তন ডটকম