খালেদা জিয়ার পক্ষে দৃশ্যমান হলো কার্লাইলের তৎপরতা

বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া লর্ড এলেক্স কার্লাইলকে বিএনপি দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার পর দেড় মাস পর তার প্রকাশ্য ভূমিকা দেখা গেল।

কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি প্রধানের কারাদণ্ডকে ‘পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া’ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ রায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কার্লাইলের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সময় শনিবার দিনগত মধ্যরাতে আল জাজিরা তাদের অনলাইনে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য নেয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও তিনি আদালতের বিষয়ে বক্তব্য দিতে চাননি।

২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমানসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করা হয়। ৯০ দশকের শুরুর দিকে বিদেশ থেকে এতিমখানার নামে আসা অর্থ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নামে ট্রাস্ট খুলে তাতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সে এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। পরে সে অর্থ বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সলিমুল হক কামালের ব্যক্তিগত হিসাবে এফডিআর করে রাখা হয়।

এরপর সেই এফডিআর ভেঙে আবার ব্যবসায়ী শরফুদ্দীনকে দেয়া হয়। যদিও ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলাকালীন সব টাকা ট্রাস্টের ব্যাংকের একটি হিসাবে ফেরত আনা হয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি দুই কোটি ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে ঢাকার একটি আদালত। সেই থেকে তিনি নাজিমউদ্দীন রোডের পুরাতন কারাগারে অন্তরীণ।

একই রায়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানকে সমপরিমাণ জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়।

বিএনপি এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের পাশাপাশি নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। সেই সঙ্গে বিদেশে এই মামলাটি নিয়ে কথা বলার জন্য যুক্তরাজ্যের ইহুদি আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে নিয়োগ দেয়।

কার্লাইলকে খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শক হিসেবে নিয়োগে দেয়া হলেও বিএনপি নেত্রীর পক্ষে আদালতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই তার।

বাংলাদেশের আদালতে দাঁড়াতে হলে বার কাউন্সিলের সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই সনদ না থাকলে কারও পক্ষে আইনগত সহায়তা দেয়া সম্ভব নয়। ইতোপূর্বে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তবে তারা বাংলাদেশে এসে আইনগত সহায়তা দিতে পারেননি।

তবে কার্লাইলের ভূমিকা কী- তার নিয়োগের কিছুদিন পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদিনের কাছে প্রশ্ন ছিল ঢাকাটাইমসের। তিনি সেদিন বলেন, ‘তিনি (কার্লাইল) বাংলাদেশে এসে মামলা পরিচালনা করবেন না। তিনি এ বিষয়ে বিবৃতি দিতে পারেন।’

গত দেড় মাসে কার্লাইলের কোনো বিবৃতি বা তার মামলা নিয়ে কোনো তৎপরতার খবর বাংলাদেশে না আসলেও খালেদা জিয়াকে দেয়া জামিনের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির তিন দিন আগে আল জাজিরা এই ব্রিটিশ আইনজীবীর বরাত দিয়ে বক্তব্য ছাপিয়েছে।

গত ১২ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেয়া চার মাসের জামিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন যে আপিল করেছে, তার ওপর শুনানি হবে মঙ্গলবার।

আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কার্লাইল দাবি করেন, খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া যায় এমন কোনো প্রমাণ তিনি মামলার নথিপত্রে খুঁজে পাননি।

‘আমার মক্কেল কোনো ধরনের দুর্নীতি করেছেন, সেটি আমি দেখতে পাইনি।’

খালেদা জিয়ার আইনি পরামর্শকের দাবি, চলতি বছরের শেষ দিকে যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেটাই খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেয়ার প্রধান কারণ। তার বিবেচনায়, ‘সরকার চায় না খালেদা জিয়া নির্বাচনের আগে নিজে প্রচারে নামুন।’

খালেদা জিয়া বাংলাদেশে তিনবার প্রধানমন্ত্রী থাকলেও আল জাজিরা তাকে দুই বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছে। ১৯১৬ থেকে ৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ করলেও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির এক তরফা নির্বাচনে জিতে এক মাসেরও কম সময় ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেনি আল জাজিরা।

প্রতিবেদন তৈরির জন্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গেও যোগাযোগ করে আল জাজিরা। তবে তিনি কার্লাইলের বক্তব্যের জবাব দিতে চাননি। বলেন, ‘এটা আদালতের বিষয়। এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতাদের পক্ষে গলা ফাটানো কার্লাইলকে নিয়োগ দেয়ায় বিএনপির সমালোচনা করে আইনমন্ত্রীর আগের বক্তব্যও তুলে ধরেছে আইনমন্ত্রী।

পোল্যান্ড থেকে যুক্তরাজ্যে অভিবাসিত ইহুদি আইনজীবী লর্ড কার্লাইল বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কট্টর সমালোচক ছিলেন। তিনি এই বিচারের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে নানা সভা, সেমিনার এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দূতিয়ালির চেষ্টা করেছেন।

২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ‘নিরপেক্ষতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার’ জন্য আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি জানান লর্ড কার্লাইল। জেনেভাস্থ ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন ফর হিউম্যান রাইটস-এর হাই কমিশনার নাভী পিল্লাই বরাবর লিখিত এক চিঠিতে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপও চেয়েছিলেন লর্ড কার্লাইল।

আলবদর নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর না করার দাবিতে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের কাছে চিঠিও লিখেছিলেন ব্রিটিশ এই আইনজীবী।

২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশে ‘গ্রহণযোগ্য’ সরকার গঠনে উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অনুরোধ করেছিলেন লর্ড কার্লাইল।

তবে কার্লাইল তার নিজের সঙ্গে জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, জামায়াত নেতাদের হয়ে নয়, একজন আন্তর্জাতিক আইনজীবী হিসেবে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন।

জামায়াতের পক্ষে দূতিয়ালি করলে জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুললে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সতর্কতাও মার্চের শেষ দিকে দিয়েছিলেন কার্লাইল।