জামায়াত ছাড়ার চাপকে ‘পাত্তা’ দিচ্ছে না বিএনপি

জোট গঠন হওয়ার শুরুতে জামায়াতে ইসলামী প্রসঙ্গটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। নির্বাচনের পরে এসে সেই প্রসঙ্গ আবারও আলোচিত। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন এবার সরাসরিই বললেন, জামায়াতের সঙ্গে ধানের শীষে নির্বাচন করাটা ভুল ছিল। জোটের অন্য নেতারাও বলছেন, জোটের স্বার্থেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে। তবে শরিক দলগুলোর এই চাপ বিএনপি তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।

গত বছরের জুন-জুলাইয়ে বিএনপি সরকার বিরোধী জোট গড়ে তুলতে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। সব দলগুলোর মধ্যেই নানান- হিসাব নিকাশের মধ্যে অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল- জামায়াত থাকবে কিনা। গণমাধ্যমে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকেরা তখন বলে এসেছেন বিএনপি জামায়াত ছেড়ে এলে জাতীয় ঐক্য হবে। অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। তখন ঐক্যফ্রন্ট থেকে বারবার বলা হয়েছে তাদের সঙ্গে জামায়াত নেই।

কিন্তু পরে দেখা গেল জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করেছে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারাও তখন ধানের শীষের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। জোট গঠনের আগে থেকে এখন পর্যন্ত জামায়াতকে না রাখতে ঐক্যফ্রন্টের বিএনপি ছাড়া অন্য শরিকদের চাওয়াকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না বিএনপি। জামায়াতকে ছাড়ার ব্যাপারে বিএনপি দলটির মধ্যে কোনো আলোচনাও নেই।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘ড. কামাল হোসেন তাঁর দলের কথা বলেছেন। আমরা এখনো এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করিনি। শরিকেরা কী চান না চান, সেটা এখনো আলোচনাই হয়নি।’

নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আসন বণ্টন বিষয়টি আলোচনায় আসে। জামায়াত ২০ থেকে ২৫টি আসনে মনোনয়ন পাবে বলে খবর চাউর হয়। শেষ পর্যন্ত তারা ২২টি আসন নিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে। তবে কামাল হোসেনসহ ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিকরা বলছে, ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা আগে জানতেন না।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্ট আটটি আসন জেতে। তবে তারা ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি করে আসছে। জাতীয় সংলাপ, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলাসহ কিছু কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। তবে সব ছাপিয়ে গতকাল কামাল হোসেনের দেওয়া বক্তব্যে জামায়াতকে ছাড়ার বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। গণফোরামের সভা শেষে কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে অতীতে যেটা হয়েছে, সেটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। বিএনপি যে ধানের শীষে জামায়াতের ২২ জনকে মনোনয়ন দেবে, সেটি আমরা জানতাম না।’ বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলা যেতে পারে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া একই দিনে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেছেন, তাঁরা এ বিষয়টির সুরাহা চান।

গণফোরামের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, জামায়াত ধানের শীষে নির্বাচন করবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনেক পরে। তাঁর দাবি তখন শরিকদের কিছু করার ছিল না। তখন ঐক্য ভেঙে দিলে নির্বাচন নিয়ে বাজে অবস্থা তৈরি হতো। প্রস্তুতি কম থাকায় সবকিছু তাড়াহুড়া করে করা হয়। এই নেতা আরও বলেন, সরকার অনেক ইসলামী দল নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু জামায়াতকে করছে না। কারণ জামায়াতকে রেখে দিয়েছে কাদা ছিটানোর জন্য।

গণফোরামের আরও কয়েকজন নেতা বলেন, গণফোরাম ঐক্য ধরে রাখতে চায়। তবে তাদের চাওয়া বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে।
বিএনপির এক সূত্র জানায়, নির্বাচনে প্রথমে সিদ্ধান্ত ছিল জামায়াত স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করবে কিন্তু বিএনপি সমর্থন দেবে। কিন্তু মনোনয়নের একদম শেষ মুহূর্তে এসে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ধানের শীষ দেওয়া হয়। বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানায় এ সূত্র। নির্বাচনের দিন জামায়াতের প্রার্থীরাই একসঙ্গে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।

জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘কামাল হোসেন যা বলেছেন তা নিয়ে জোটের মধ্যে আলোচনা হবে। আমরা জেএসডি জামায়াতের সঙ্গে জোটের পক্ষে না।’ নির্বাচনের পরে এসে এখন জামায়াত নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, নির্বাচনের আগে দৌড়াদৌড়ির মধ্যে জামায়াত প্রসঙ্গে আলোচনার সুযোগ হয়নি। নির্বাচনের পরেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয় আলোচনায় আসেনি। এজেন্ডা আকারে ওঠেনি। জেএসডি তাদের অবস্থান তুলে ধরবে। তিনি বলেন, ‘জোট টিকিয়ে রাখতে হলে জামায়াত ছাড়তে হবে। কথা তো ছিল আমাদের সঙ্গে জোট। কিন্তু এখানে ধানের শীষ মার্কা জামায়াতকে ভাড়া দেওয়ার প্রশ্ন আসবে-সেটা আলোচনায় ছিল না। কিন্তু আমাদের সঙ্গে স্পষ্ট কথা ছিল যে আমরা জামায়াতের সঙ্গে কোনো জোট করব না।’

ঐক্যফ্রন্টের আরেক শীর্ষ নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনো সম্পর্কই আমরা জামায়াতের সঙ্গে রাখতে চাই না। মিটিংয়ে এ বিষয়টি উঠবে। ঐক্যফ্রন্ট রাখতে হলে জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে বিএনপিকে বলা হবে।’ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, তাঁরা জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে এ কথা বলতে হলে দলীয়ভাবে এবং জোটগতভাবে আলোচনা করতে হবে।

কামাল হোসেনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী দল। জোটের স্বার্থে জামায়াতকে বিএনপি ছাড়বে কিনা- সেটা দল চিন্তা করবে, আলোচনা করবে। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে জামায়াতকে নেওয়া ঠিক হয়নি।

মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দলের শীর্ষ নেতা জেলে এবং যিনি দল চালাচ্ছেন তিনি দেশের বাইরে। একটা কনফিউশন দলের মধ্যে আছে। কিছু সমস্যা তো আছেই। মহাসচিব চেষ্টা করছেন। সামনে উপজেলা নির্বাচন। সে সময় এ প্রশ্নটা আসবে। তার আগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এর নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।’-প্রথম আলো’র সৌজন্যে।