নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে লেজেগোবরে অবস্থা জামায়াতের

দলকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর পুরনো দাবিতে আবার সোচ্চার জামায়াতের তরুণ নেতারা। তারা চাইছেন, একাত্তরের কলঙ্কিত ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন নামে দল গঠন করতে। নতুনদের দাবি বাস্তবায়নে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও বাধ সাধছেন জামায়াতের প্রবীণ নেতারা। তাই করণীয় নির্ধারণে শিগগির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দলের নীতিনির্ধারকরা।

নবীন-প্রবীণের এমন দ্বন্দ্বের মধ্যে দল থেকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলে পদত্যাগসহ নানা জটিলতা ভর করেছে দলটিতে। এমনকি দলের সংস্কার চাওয়ায় তরুণ নেতাদের বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটছে। সব মিলিয়ে এখন লেজেগোবরে অবস্থা একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে।

জামায়াতের সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর গত জানুয়ারিতে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভায় নাম বদলের পাশাপাশি একাত্তরের ভূমিকার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব করেন দলের তরুণ নেতারা। সেখানে জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে দলকে নিয়োজিত করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরে দলের মজলিশে শূরায় অনুমোদন পায়নি এ সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে দলটির নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হয়েছে।

এর আগে ২০১০ সালে জামায়াতকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করেছিলেন দলটির তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া কামারুজ্জামান। গ্রেপ্তারের কিছুদিন পর এক চিঠিতে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুনদের হাতে জামায়াতকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। দলের নাম পরিবর্তনেরও পরামর্শ দেন তিনি। দলের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামীর পরিবার এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাধার মুখে পড়ে সে প্রস্তাব আর পাত্তা পায়নি। তবে দলের তরুণ নেতারা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তারাই দলে পরিবর্তনের বিষয়টি একন আবার সামনে এনেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতের একাধিক নেতা জানান, বর্তমানে দলের কার্যক্রম অনেকটাই এলোমেলো। নেতাদের মধ্যকার মতের অমিল এত প্রকটভাবে আর কখনো দেখা যায়নি। এ কারণে করণীয় নির্ধারণে শিগগির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না দলের নীতিনির্ধারকরা।

দলের অভ্যন্তরিন কোন্দল ও সমস্যা মেটাতে না পেরে বিএনপি ও ২০ দল ছাড়ার বিষয়ে আলোচনা চললেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না দলটি। এরই মধ্যে শুক্রবার পদত্যাগ করেন জামায়াতের থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এতে আর এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ে দলটি। দলের আমির মকবুল আহমাদকে পাঠানো পদত্যাগপত্রে ব্যারিস্টার রাজ্জাক দলের একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়ার পরামর্শ দেন।

ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগগের বিষয়ে শুক্রবার বিকালে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল সেক্রেটারি ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তার পদত্যাগে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। পদত্যাগ করা যেকোনো সদস্যের স্বীকৃত অধিকার। আমরা আশা করি তার সাথে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।’

এদিকে ২০-দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়া বা বিএনপিকে ছাড়ার বিষয়ে দলীয় ফোরামে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘প্রয়োজন অনুযায়ী রাজনীতিতে পরিবর্তন হতে পারে। নতুনত্বও আসতে পারে। তবে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট সরকারবিরোধী ঐক্যফ্রন্টের জন্য নেতিবাচক ছিল বলে মন্তব্য করেন ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন। গত ১২ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপিকে পরামর্শ দেন তিনি। বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, ‘আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, জামায়াতকে নিয়ে কোনো রাজনীতি করব না আমরা। অবিলম্বে জামায়াতের বিষয়ে বিএনপির কাছ থেকে আমরা সুরাহা চাই।’

কামালের এমন বক্তব্যের পরে ধারণা করা হয়েছিল, হয়তো এবারই ছিন্ন হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের বন্ধন। তবে কামালের বক্তব্যের পর মাস পেরিয়ে গেলেও জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি বিএনপির তরফ থেকে। উল্টো জামায়াত বিএনপিকে ছেড়ে যাচ্ছে বলে খবর চাউর হয়েছে।

জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের পরে গত মাসের মাঝামাঝি দলের মজলিশে শূরার বৈঠক হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আগামী দিনের করণীয় নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে কামালের বক্তব্য এবং বিএনপি ও জোট ছাড়ার বিষয়টি আলোচনার টেবিলেই ওঠেনি।

১৯৯৮ সালে জোটবদ্ধ হয় বিএনপি-জামায়াত। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ এবং জামায়াত ১৭টি আসনে জয় পায়। জোটবদ্ধ নির্বাচনে জয়ী হয়ে জামায়াত প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে কোনো সরকারে অংশ হয়। এ নিয়ে সমালোচিত হয়ে আসছে বিএনপি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভরাডুবি হয়। ওই নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানে বিএনপির পক্ষ থেকে গঠন করা একাধিক তদন্ত কমিটি। কমিটির প্রতিবেদনে জামায়াতকে ছাড়ার সুপারিশ করা হয়। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তার তৃণমূলের পরামর্শ এড়িয়ে যায়। ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের পর একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, সময়মতো জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবেন তারা। দশম সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে বর্জনের পর একাদশ নির্বাচনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের ২১ প্রার্থীর হাতে ধানের শীষ তুলে দেয় বিএনপি।-খবর ঢাকা টাইমসের সৌজন্যে।