নিজ শিক্ষককে লাঞ্ছিত করলেন এমপি কমল

কক্সবাজার সদর আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) সাইমুম সরওয়ার কমলের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন রামুর এক প্রবীণ শিক্ষক। ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য একটি অনুষ্ঠানে অতিথি দাওয়াত দেয়াকে কেন্দ্র করে শিক্ষকের ছেলের সঙ্গে মতবিরোধের জের ধরে জনসম্মুখেই ন্যাক্কারজনক এ ঘটনাটি ঘটান আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্য। লাঞ্ছনার শিকার শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা সংসদ সদস্য কমলকে শিশুকালে পড়িয়েছেন।

রোববার দুপুরে রামু উপজেলার জোয়ারিয়ানালায় নির্মিতব্য বিকেএসপি মাঠ এলাকায় জনসম্মুখে এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা রামুর চৌমুহনী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা।

শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা বলেন, ২০১৪ সালে রামুর উত্তর কাহাতিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর নেন তিনি। বর্তমানে ঈদগাঁওর কালিরছরায় বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি খালেকুজ্জামান ও শহিদুজ্জামানের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত রত্নাগর্ভা রিজিয়া আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিদিনের মতো রোববার দুপুর দেড়টার দিকে বর্তমান স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। এ সময় জোয়ারিয়ানালা বাজারে দক্ষিণ পাশে বিকেএসপির নির্মিতব্য মাঠে মাটি ভরাট কাজ উদ্বোধন উপলক্ষে স্থানীয় এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলসহ অন্যদের দেখে গাড়ি থেকে নামেন তিনি। সবার সঙ্গে কাজ উদ্বোধনী মোনাজাতে অংশ নেন।

মোনাজাত শেষ করে এমপি কমল তার দিকে এগিয়ে এসে স্যার সম্বোধন করে কুশল বিনিময় করেন। স্কুল থেকে ফিরছি শুনে হঠাৎ বলেন, ‘তোর ছেলে সুজন ঢাকায় আমার বিরুদ্ধাচরণ করছে। আমার মতের বাইরে যাওয়া আমি একদম পছন্দ করি না। তাকে সাবধান করে দিস। নইলে গায়েব করে ফেলব।’

শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মা বলেন, আমি হতভম্ব হয়ে ‘তুই-তোকারি’ করে কথা বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি আরও কাছে এসে গলায় হাত দিয়ে ধাক্কা মারেন। এরপর পাঞ্জাবি টেনে ধরে বলেন, ‘তোর ছেলেকে সাবধান করবি। নইলে খবর আছে।’ উপস্থিত সবাই আশ্চর্য হয়ে বিষয়টি চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কেউ এমপি কমলের অপকর্মের প্রতিবাদ করেনি।

সুনীল কুমার শর্মা বলেন, প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে এলাকার সবাই আমাকে সম্মান করেন। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত নই। আমার ছেলে সুজন শর্মা ঢাকায় রামু সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সমিতির অভিষেকে অতিথি দাওয়াত নিয়ে সুজনের সঙ্গে কমলের বিরোধ হয়েছে। ছেলের সঙ্গে বিরোধের জন্য প্রকাশ্যে আমারই ছাত্র এমপি কমল আমাকে লাঞ্ছিত করল।

তিনি আরও বলেন, এটি বড়ই লজ্জার। ভাবতেও আমার গা শিউরে উঠছে। আমি রামু শহরের মণ্ডলপাড়ার বাড়িতে গিয়ে কমলকে পড়িয়েছি। এখন কমল সংসদ সদস্য। এটা নিয়ে গর্ব হয়। তাই আসার পথে উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করছে দেখে আনন্দিত হয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, নিজেই নিজের লাঞ্ছনা হাতে ধরে এনেছি। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

ঢাকাস্থ রামু সমিতি সূত্র জানায়, ঢাকায় রামু সমিতির বার্ষিক উৎসব আগামী শুক্রবার। এ উৎসবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) এর চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদসহ অনেকে অতিথি হিসেবে দাওয়াত পেয়েছেন। উৎসব নিয়ে গত শুক্রবার মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির মাঠে এমপি কমলের সঙ্গে রামু সমিতির নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে কউক চেয়ারম্যান ফোরকান আহমদকে অতিথি করার ব্যাপারে আপত্তি তোলেন এমপি কমল। তখন সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুজন শর্মা বলেন, ফোরকান আহমদ রামু সমিতির উপদেষ্টা। তিনি অতিথি হিসেবে থাকতেই পারেন। এ সময় এমপি কমল উত্তেজিত হয়ে বলেন, রামু সমিতিতে সুজন শর্মা থাকলে উৎসব হবে না। এরপরও উৎসবের আয়োজন করলে তিনি তা প্রতিরোধ করবেন। এ বলে তিনি বৈঠক ছেড়ে চলে যান।

সুজন শর্মা তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, এমপি কমল চান রামু সমিতি তার ইশারায় চলবে। কিন্তু আমরা এটাকে ব্যক্তিগত সংগঠন হিসেবে মানতে নারাজ। রামুর সবার স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে আমরাই রামু সমিতি গড়েছি। তার মতের বিরোধিতা করার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এমপি কমল আমার বৃদ্ধ বাবাকে লাঞ্ছিত করলেন। বাবা তার শিক্ষক ছিলেন সেটাও ভুলে গেছেন এমপি কমল।

রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল বলেন, এমপি কমলের হাতে প্রবীণ শিক্ষক সুনীল কুমার শর্মার লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাটি দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। সোমবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের এক সভায় ঘটনাটি নিয়ে আলোচিত হলে এমপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম মণ্ডল বলেন, এমপি কমল প্রতিহিংসা পরায়ণ, এটা কমবেশি সবাই জানে। তবে ছেলের ওপর বিরাগভাজন হয়ে তিনি এভাবে একজন প্রবীণ শিক্ষককে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করবেন এটা কল্পনাও করিনি।

অপর একটি সূত্র জানায়, বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর নানা অপকর্মের জন্য বিতর্কিত হয়েছেন এমপি কমল। আগামী সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। তার ভাই কাজল ও বোন নাজনীন সরোয়ার কাবেরীও এ আসনে মনোনয়ন চাইবে বলে প্রচার রয়েছে। আবার বিকল্প হিসেবে কমলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছে কউক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদকে। তাই ফোরকান আহমদকে যেখানে অতিখি করা হয় সেসব অনুষ্ঠান এমপি কমল কৌশলে এড়িয়ে যান। পারলে আয়োজকদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফোরকান আহমদকে অতিথি থেকে বাদ দেন।

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোন নাম্বারে কল করা হয়। বার বার নাম্বার ব্যস্ত পাওয়ার পর বক্তব্যের বিষয় উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়। এতেও তিনি সাড়া দেননি।