নির্বাচনের বছরে যে সিদ্ধান্তে ব্যাংকারদের উদ্বেগ

ঋণ এবং আমানতের অনুপাত (অ্যাডভান্সড ডিপোজিট রেশিও-এডিআর) কমিয়ে আনা হলে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরির আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্যাংকগুলোর এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) দাবি করছে, এতে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যাবে। যা নির্বাচনী বছরে সামাল দেওয়া কঠিন হবে।

এমন যুক্তি দিয়ে এডিঅার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি নেওয়া সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানিয়ে গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি।

গত ৩ জানুয়ারি এডিআর কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বিজ্ঞপ্তি জারি করে এডিআরের নতুন অনুপাত নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। সেখানে সাধারণ ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এডিআর হবে ৮০ শতাংশ এবং ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশের কিছু বেশি হতে পারে।

এমন সিদ্ধান্ত জানার পর ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে এবিবির পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে, নিকট ভবিষ্যতে এডিআর কমিয়ে ৮০ দশমিক ৫ শতাংশের আশপাশের ঘরে নামিয়ে আনা হবে। যদি তাই হয়, তবে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার আমানতের প্রয়োজন হবে। আর আমানত সংগ্রহ করতে হলে সুদ হার বাড়াতে হবে। এতে ব্যাংক ব্যবস্থায় নতুন আমানত আসবে তাও নয়। শুধু এক ব্যাংকের আমানত আরেক ব্যাংকে যাবে।

‘ফলে যে ব্যাংক আমানতের সুদ বাড়াবে, বিদ্যমান আমানতকারীরা অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে সেই ব্যাংকে খাটাবে। আবার আমানতের সুদ বাড়লে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদ হারও বাড়িয়ে দেবে, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করবে।’

বর্তমানে সাধারণ ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করে তার সর্বোচ্চ ৮৫ টাকা ঋণ দিতে পারে। আর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারে সর্বোচ্চ ৯০ টাকা পর্যন্ত।

সম্প্রতি দেখা গেছে অনেক বেসরকারি ব্যাংকেরই এডিআর ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণে তারল্য বা নগদ টাকার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় আগ্রাসী ঋণ বিতরণ বন্ধে এডিআর কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তখন বলা হয়, সার্কুলার ইস্যু করে এডিআর নতুন হার নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এ হার সাধারণ ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ৮০ ও ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশের কিছুটা বেশি হতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন এডিআর নীতিমালা বাস্তবায়ন করলে ব্যাংকগুলোর চলমান ঋণ বিতরণ চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে-এমন আশঙ্কা করে ওই চিঠিতে বলা হয়, এ আইন বাস্তবায়ন হলে চলতি মূলধন ঋণ, গ্রাহকের পক্ষে আমদানি বিলের অর্থ পরিশোধ ও চলমান বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে গ্রাহক তথা রপ্তানিকারক, এসএমই ও কর্পোরেট গ্রাহকদের তহবিল সংকটে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

বিশেষ করে নির্বাচনী বছরে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ব্যাংকগুলোর পক্ষে কঠিন হবে। কারণ নির্বাচনী ব্যয় মেটাতে অনেকে ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিবেন। তবে এডিআর নীতিমালা বাস্তবায়ন করার জন্য কমপক্ষে একবছর সময় দেয়া উচিত।

এ বিষয়ে প্রস্তাব দিয়ে এবিবি’র চিঠিতে আরও বলা হয়, বিকল্পভাবে এডিআর বিষয়টি ক্যামেলস রেটিংয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অর্থাৎ, যাদের এডিআর বেশি হবে তাদের ক্যামেল রেটিংয়ে নেতিবাচক হবে।

এছাড়াও ব্যাংকের মূলধন ভিত্তি বাড়াতে টায়ার-২ এর আওতায় সাব-অর্ডিনেটেড বন্ডের যে তহবিল রয়েছে, সেটা এডিআর হিসাবে গণ্য করা ও অফ ব্যালেন্স শিট আইটেমের বিপরীতে ব্যাংকের যে এক শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়, সেটাতে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে এবিবি।

বিষয়টি জানাতে যোগাযোগ করা হলে দেশের বাইরে থাকায় এবিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমানের মন্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, আমানত বাড়াতে নতুন বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকসহ বেসরকারি কোনো কোনো ব্যাংকও আমানতের সুদ হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ বাড়িয়ে ৩ মাস মেয়াদী আমানতে সুদ দিচ্ছে ৫ শতাংশ।

একই আমানতে রূপালী ব্যাংক শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে সুদ হার সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। প্রায় একই ভাবে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ সুদে মেয়াদী আমানত নিচ্ছে ঢাকা ব্যাংক। প্রায় সাড়ে আট শতাংশ সুদ দিচ্ছে এনআরবিসি ব্যাংক। একইভাবে অন্য ব্যাংকগুলোও আমানতে সুদ হার বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল এসএম পারভেজ বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সাধারণ ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণের সুযোগ দেয়া এক ধরনের বৈষম্য বলে মনে হচ্ছে।

তিনি বলেন, এডিআর কমানোর কারণে ব্যাংক খাতে আমানতের বাজার অস্থির হয়ে পড়বে। কারণ ব্যাংকগুলো বড় বড় ডিপোজিটরদের টানবে। তখন সুদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আমরাও আমানতে সাড়ে চার থেকে সাড়ে আট শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছি।

এডিআর কমানোর ফলে আবারও অলস টাকার পরিমাণ বেড়ে যাবে- এমন মন্তব্য করে এই ব্যাংক উদ্যোক্তা বলেন, অর্থনীতিতে এখন খুব সংকট মনে হয় নাই, তাই এডিআর কমানোর কোনো দরকার আছে বলেও মনে হয় না।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম বলেন, উদ্যোক্তারা আগ্রাসী ভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ছে। এ সংকট মেটাতে আমানতের সুদ হার বাড়াচ্ছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। যদিও সুদ হার বাড়ানোর দরকার নেই তবু বিনিয়োগের বিষয় মাথায় রেখে আমরাও কিছুটা বাড়িয়েছি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। অবশ্য গত নভেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ।-চ্যানেল আই অনলাইন