রোডম্যাপ চূড়ান্ত, ঈদের পরই মাঠে নামছে আ.লীগ

ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, ধরে নিয়েই হ্যাটট্রিক জয়ের লক্ষ্যে ছক কষে ঈদের পর থেকেই দেশজুড়ে প্রচারণায় নামছে আওয়ামী লীগ। টানা তৃতীয়বার সরকার গঠনের লক্ষ্য নিয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ চুড়ান্ত করেছে দলটি। দেশের সর্বস্তরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী সহজেই পাড়ি দিতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেছেন দলের নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, সংবিধানে যেভাবে রয়েছে সেভাবেই সময়মতো আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কীভাবে হবে তা আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার সর্বোতভাবে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।

শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যেই একটি রোডম্যাপ চুড়ান্ত করা হয়েছে দলীয় ফোরামে। দেশের ৩০০ নির্বাচনী আসনকে ১৫ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, প্রতিটি টিমে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে রাখা হয়েছে জেলা পর্যায়ের নেতাদেরও। রোডম্যাপ অনুযায়ী ঈদের পর পরই ১৫টি টিম সারাদেশে মাঠে নামবে। টিমের নেতারা বিভিন্ন জেলায় যাবেন এবং সংসদীয় আসনকেন্দ্রীক সাংগঠনিক সভা করবেন। কোনো আসনে নেতাকর্মীদের মাঝে গ্রুপিং-বিভেদ থাকলে জরুরীভিত্তিতে তা মিটিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিবেন। নির্বাচনী রোডম্যাপে অনুযায়ী, সবার আগে অন্তঃকোন্দলও মিটিয়ে ফেলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, দলীয় ঐক্যই খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকাকে বিজয়ী করেছে। এতদিন আওয়ামী লীগের ভাবনায় ছিল ব্যাপক উন্নয়ন হলেও হয়তো অভ্যন্তরীণ কোন্দল নির্বাচনে দলকে বেকায়দায় ফেলবে। কিন্তু খুলনায় বিজয়ের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী জোট ঐক্যবদ্ধ আছে এবং থাকবে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এখনো নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এ দলটির নীতিনির্ধারকরা।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারো বড় বিজয়ে আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিপুল ভোটের ব্যবধানে নৌকার বিজয় জোটের আত্মবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের মধ্যে একটা স্বস্তি বিরাজ করছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিজয়ের ধারা শুরু হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রেখে টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার গঠন করে রেকর্ড গড়া সম্ভব হবে।

পরিকল্পিত রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে বড় ধরনের জয়ের স্বাদ নিতে চায় উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, রোডম্যাপ অনুযায়ী ঈদের পর পরই দ্রুততার সঙ্গে আমার আমাদের সাংগঠনিক কাজগুলো গুছিয়ে ফেলতে চাই। সেই অনুযায়ী শুরুতেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বর্ধিত সভা ও কর্মীসভার। এসব সাংগঠনিক সভার পাশাপাশি চলবে সমাবেশ, জনসভা ও গণসংযোগ। এরই মধ্যে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীর নিজ নিজ এলাকায় সময় দিচ্ছেন, আরো বেশি জনসম্পৃক্ত হতে অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় নানা কর্মসূচিতে।

তিনি আরো বলেন, পরিকল্পিত রোডম্যাপ অনুযায়ীই আমরা এগুচ্ছি। এ পর্যন্ত যে অগ্রগতি তাতে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। রোডম্যাপ অনুযায়ী প্রতিটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই এবং নির্বাচনী ইশেতহার তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দলের নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড দুটি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটি হলো পোলিং এজেন্টস প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। যেখানে প্রথমে মাস্টার্স ট্রেইনার্স তৈরি করা হবে, যারা বিভাগে গিয়ে এজেন্ট শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এরপর এজেন্ট প্রশিক্ষকরা জেলায় গিয়ে স্থানীয় এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এভাবে তৃণমূল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ পৌঁছে যাবে। আরেকটি হলো দলের ওয়ার্ড থেকে জেলা-মহানগর পর্যন্ত কমিটিগুলোকে গুছিয়ে আনা। যেখানে কমিটি দেয়ার দরকার সেখানে কমিটি দেয়া হবে, যেখানে বিভাজন মেটানো দরকার সেখানে তাই করা হবে। এ ছাড়া প্রার্থী মনোনয়নের জন্য তৃণমূল থেকে পাঠানো প্যানেলের মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত করার যে প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে, সেটাকে প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে আরো জোরদার করা হবে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে দল নির্বাচনমুখী হয়ে উঠছে।

সুত্র জানায়, ঈদের পরই জেলাভিত্তিক দলীয় কর্মসূচিতে ব্যস্ততা বাড়বে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা সফর বাড়িয়ে দেবেন। নিকট অতীতে যাননি এমন জেলাগুলোয় যাবেন তিনি। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তরের পাশাপাশি প্রতিটি জেলায় জনসভা করবেন তিনি। যাকে এক অর্থে নির্বাচনী সফরও বলা যেতে পারে। এরইমধ্যে তিনি সিলেট, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম সফর করে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। দলীয় প্রধানের সফরের সমান্তরালে কেন্দ্রীয় নেতারাও সাংগঠনিক সফরে সারা দেশে বর্ধিত সভা-জনসভা-পথসভা চালিয়ে যাবেন। এভাবে চলবে জুলাই পর্যন্ত। এর মধ্যেই ২৩ জুন আনন্দ-উৎসবের আমেজে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হবে। আগস্টজুড়ে চলবে শোকের কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পাশাপাশি দলের প্রতিটি সহযোগী সংগঠন শোকসভার আয়োজন করবে। এ ছাড়া ভ্রাতৃপ্রতিম ও সমমনা সংগঠনগুলোর কর্মসূচি তো থাকছেই। আগস্ট শেষ হলেই সেপ্টেম্বর থেকে পুরো দল নামবে প্রকাশ্যে নির্বাচনী কার্যক্রমে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে বিরোধপূর্ণ আসনগুলোর তালিকা তৈরি করে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে কয়েক দফা রাজনৈতিক মাঠের চিত্র তুলে আনা হয়েছে। ওইসব রিপোর্টের সঙ্গে সাংগঠনিক রিপোর্ট মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। এরপর দলীয় কোন্দল মেটাতে হস্তক্ষেপ করবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি। প্রয়োজন হলে দলের সভাপতি আলাদাভাবে তাদের ডেকে পরামর্শ দেবেন। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে প্রস্তুতি নিতে চায় আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী প্রচারণায় দুইটি ইস্যু গুরুত্ব পাবে জানিয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, দেশের ব্যাপক উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ও সাফল্যকে তুলে ধরা হবে প্রচার-প্রচারণায়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষপণের মাধ্যমে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পাবে প্রচারে। দ্বিতীয় ইস্যুটি হলো, দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড। বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান চুরির দায়ে, এতিমের টাকা আত্মসাতের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হবেন- এটা মানুষ কখনই আশা করে না। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। রাজনীতির জন্য লজ্জাজনক। সাধারণ মানুষ এই ব্যাপারগুলোকে সেভাবেই দেখে। এসব কারণে সাধারণ মানুষ বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার জন্য আজ ঐক্যবদ্ধ।

ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সভানেত্রীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পুরোপুরিই শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কিছু ঘটবে না। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই শেষ হবে। বিএনপিসহ সকল দলই শেষপর্যন্তে নির্বাচনে আসবে, ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হবে।