আন্দোলন থামানোর প্রক্রিয়াকে দানবীয় বললেন জাফর ইকবাল

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আমরণ অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, তোমাদের প্রাণ অনেক মূল্যবান। এ প্রাণ এরকম একজন মানুষের জন্য তোমরা বিপদপগ্রস্ত করবে না, তোমরা বিপদে পড়বে না।

বুধবার (২৬ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পানি পান করিয়ে টানা ৭ দিন পর শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এরপরেই তিনি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন।

এ সময় তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের অনুরোধ রক্ষা করে আজকে সকালে অনশন ভেঙেছে। আমি আমার জীবনে এর থেকে বেশি আনন্দ কখনো পাইনি। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন তাদের হাসপাতালে নিতে হবে তারা যেন সুস্থ হয়ে ওঠে ঠিকভাবে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

জাফর ইকবাল আরও বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি এই ছেলেমেয়েদের আন্দোলন থামানোর জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলো অমানবিক, নিষ্টুর ও দানবীয়। আমি ধরে নিয়েছিলাম এখানে একটা মেডিকেল টিম থাকবে, যারা এই ছেলেমেয়েদের দেখবে। আমি খুবই ব্যথা পেয়েছি যখন দেখেছি এখানে কোনো মেডিকেল হেল্প নেই।

তিনি বলেন, তাদের সাহায্য করার জন্য যারা টাকা দিয়েছে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এ মুহূর্তে হাজতে রয়েছে এবং তাদের কোর্টে চালান করে দেওয়া হবে। এর চেয়ে নিন্দনীয় ব্যপার কিছু হতে পারে কিনা আমার জানা নেই। তাদের বিরুদ্ধে ২০০-৩০০ মামলা করা হয়েছে কোনো নাম ছাড়া। যখন প্রয়োজন হবে তখন একজনের নাম ঢোকানো হবে। এগুলো যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়।

শাবিপ্রবির সাবেক এ অধ্যাপক বলেন, আমি এখানে আসার আগে সরকারের অনেক উচ্চ মহল থেকে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলে এখানে আসছি। আমি তাদের অনুরোধ করব তারা আমাকে যে কথাগুলো দিয়েছেন সেগুলো যেন রক্ষা করেন। আমাকে যে কথাগুলো তারা দিয়েছেন সেগুলো যদি রক্ষা করা না হয় আমি বুঝে নেব আমার সঙ্গে, ছাত্রদের সঙ্গে এবং এ দেশের যত প্রগতিশীল মানুষ আছে সবার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

জাফর ইকবাল আরও বলেন, ছাত্ররা যে কি পরিমাণ কষ্ট করেছে আমি চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। তাদের খাওয়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এ ধরনের নিষ্টুরতা এ স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে হবে এটা চিন্তার বাইরে। এ সময় সাংবাদিকদের ভূমিকার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

জাফর ইকবাল বলেন, আমি অনশন এবং আন্দোলন এ দুইটাকে ভিন্নভাবে দেখি। এ আন্দোলনে তাদের যে উদ্দেশ্য সেখানে অনশন করার কোনো দরকার নেই। কারণ যে মানুষের জন্য তারা অনশন করছে তার জন্য প্রাণ দেওয়া উচিত না। তারা যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলন করেছে তাতে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

উচ্চ মহল থেকে সব কিছু মেনে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যদি না মানে তাহলে আপনার কোনো ভূমিকা থাকবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, অবশ্যই আমার ভূমিকা থাকবে। আমি তাদের বলব, আপনারা আমার কাছে আসছেন আমি তাদের কাছে যাইনি।

এ আন্দোলনের জন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার জায়গায় যেতে চাই না। এটা ছাত্ররা বলুক এটা তাদের জন্য সহজ।

এ আন্দোলন ৩ বছরের ক্ষোভ উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, আমি ৩ বছর আগে যখন আবসরে যাই তখন সেই চিঠিতে আমি স্পষ্টভাবে লিখে গেছিলাম যে, ছাত্রদের এখন যে ক্ষোভ আছে সেটা একসময় বিক্ষোভে রূপ নেবে। আর অক্ষরে অক্ষরে আমার কথাটা ফলেছে।

এর আগে ভোর ৪টার দিকে সহধর্মিণী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইয়াছমিন হককে সঙ্গে নিয়ে অনশনরতদের কাছে আসেন জাফর ইকবাল। তাদের সঙ্গে দু’ঘণ্টার বেশি সময় আলোচনার পর অনশন ভাঙতে রাজি হন শিক্ষার্থীরা।

তবে উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

এ সময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি আবেগি মানুষ। চোখের জল আটকাতে পারি না। আমি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী স্মারকে লিখে ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। এটা এখন তোমাদের দিচ্ছি। এখন সিআইডি দেখি আমারে অ্যারেস্ট করে কিনা। আমারে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাক।

পুলিশের উদ্দেশে জাফর ইকবাল বলেন, ছাত্রদের গায়ে হাত তুলবেন না। অলরেডি হাত তুলে আপনারা অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছেন। আর করবেন না। তাদের হয়রানি করবেন না।

শিক্ষার্থীদের সব অভিযোগ ও দাবি শোনার পর ড. জাফর ইকবাল বলেন, তোমরা আমাকে গণমাধ্যমের সামনে কথা দিয়েছ, এ অনশন ভাঙবে। তোমাদের জীবন অনেক মূল্যবান। একজন মানুষের জন্য তোমরা জীবন দিয়ে দেবে, এটা মানা যায় না। গ্রেফতার সাবেক পাঁচ শিক্ষার্থীর বিষয়ে কথা হয়েছে। যেহেতু মামলা করা হয়ে গেছে, তাদের তো আদালতে তোলা হবে। আশ্বাস পেয়েছি ছাত্রদের জামিন দেওয়া হবে।

গত ১৩ জানুয়ারি থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট কমিটির পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তার পদত্যাগ বা সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার অভিযোগে রোববার (১৬ জানুয়ারি) বিকেলে তিন দফা দাবি আদায়ে উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা।

পরে উপাচার্য পুলিশ ডেকে আনেন তাকে উদ্ধার করতে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময় পুলিশ লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। পুলিশ ৩০০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে।

১৯ জানুয়ারি বিকেলে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনের সামনে আমরণ অনশন শুরু করে ২৩ জন শিক্ষার্থী। একই দাবিতে পরদিন ২০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল বের করেন কয়েকশ’ শিক্ষার্থী।
সৌজন্যে: সময় নিউজ টিভি