আড়াই হাজার টাকায় ১০তলা ভবন, তিন হাজারে ৪ তলা লঞ্চ

বরিশাল-ঢাকা রুটের বিলাসবহুল তিনতলা একটি লঞ্চ নির্মাণ করতে খরচ হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকা। পণ্যবাহী একটি জাহাজ নির্মাণে খরচ হয় ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা। আর একটি দশতলা ভবন নির্মাণে খরচ হয় কোটি কোটি টাকা।

সেখানে মাত্র আড়াই হাজার টাকায় দশতলা সুরম্য ভবন এবং ৩ হাজার টাকায় চারতলা যাত্রীবাহী লঞ্চ পাওয়া যাচ্ছে। কল্পনা নয়, সত্যি সত্যিই বরিশালে স্বল্প খরচে নির্মিত হচ্ছে দশতলা ভবন, যাত্রী ও পণ্যবাহী জাহাজ, নৌকাসহ যে কোনো নৌযান, বসতঘর, মসজিদসহ প্রায় নানা ধরনের অবকাঠামো। তবে এগুলো আসল বসতবাড়ি কিংবা নৌপথে চলাচলের মতো উপযোগী কোনো নৌযান নয়।

কোনো ধরনের কারিগরি শিক্ষা ছাড়াই অসীম ধৈর্যের সঙ্গে শুধু বাঁশ দিয়ে দৃষ্টিনন্দন এসব শোপিস তৈরি করছেন বরিশাল নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের হরিণাফুলিয়া জাঙ্গাল সড়ক সরদার বাড়ির কাঠমিস্ত্রি আবদুর রহিম সরদারের ছেলে স্বল্পশিক্ষিত যুবক বেল্লাল সরদার। উৎপাদিত শোপিস বিক্রির জন্য বরিশাল নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের নবগ্রাম রোড সোনামিয়ার পোলসংলগ্ন (সোনা মিয়ার বাড়ির পাশে) রফিক মার্কেটে শোরুম (বিক্রয় কেন্দ্র) করেছেন তিনি।

শৌখিন মানুষ বেল্লালের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি শোপিসগুলোর নান্দনিকতা দেখে মুগ্ধ হন এবং কিনে নেন। বাঁশ দিয়ে তৈরি এসব নিপুণ শোপিস যে কোনো উৎসবে উপহার দেওয়াসহ ঘরে সাজানোর জন্য কিনে নিচ্ছেন ক্রেতারা। দামও ক্রেতার নাগালে। এখন সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শোপিস তৈরির কারখানা করে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ দেশ-বিদেশে তার শৌখিন কারুকাজের শোপিসগুলো রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করেন বেল্লাল।

কাঠমিস্ত্রি আবদুর রহিম সরদারের তিন ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে বেল্লাল সরদার দ্বিতীয়। অভাব-অনটনের সংসারে বড় ভাইয়ের লেখাপড়া হয়নি। নিজের এবং পরিবারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বেল্লালের পড়ালেখা হয়নি। এসএসসি পরীক্ষার আগে ২০০৮ সালে পড়ালেখা ছেড়ে পরিবারের ঘানি টানতে কর্মজীবনে নামতে হয়েছে তাকে। বড় ভাই ইলেকট্রিশিয়ান দুলাল সরদারের কাছ থেকে রপ্ত করেন ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ।

ফাঁকে ফাঁকে এক বছর আগে প্রথমে শখের বশে একটি কবুতরের খাঁচা তৈরি করেন তিনি। কবুতরের খাঁচা তৈরি করতে ৫ দিন লাগে। খরচ হয় ৫০০ টাকা। এরপর তিনি দিয়াশলাইয়ের কাঠি এবং বাঁশের বেতি দিয়ে ছোট একটি দোচালা কাঠ-টিনের ঘরের আকৃতি তৈরি করেন। পরে কৌতূহলবশত শুধু বাঁশের বেতি এবং সুপারগাম দিয়ে একটি চারতলাবিশিষ্ট পাকা ভবনের আকৃতি তৈরি করেন। শেষে নিজের আগ্রহে তৈরি করেন একটি চারতলা যাত্রীবাহী লঞ্চের আকৃতি।

তৈরি পণ্যগুলোর নান্দনিকতা দেখে মানুষের প্রশংসায় উদ্বুদ্ধ হন তিনি। এতে বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাস। এরপর একে একে তৈরি করেন বেতি দিয়ে দোতলা পাকা বাড়ি, দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে ডুপ্লেক্স পাকা বাড়ি, দশতলা পাকা ভবন, বাগেরহাটের ৯ গম্বুজ মসজিদ (ষাট গম্বুজ মসজিদ নয়), শহীদ মিনার, চারচালা দোতলা কাঠের ঘর, নৌকার আকৃতিসহ ১০ ধরনের শতাধিক পণ্য।

বাঁশ দিয়ে বেল্লালের হাতে তৈরি লঞ্চে রয়েছে সিঙ্গেল ও ডবল কেবিন, শোফা সেট, বাথরুম-টয়লেট, লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষ, চালকের নির্দিষ্ট স্থান (মাস্টার ব্রিজ) এবং ডেক। একইভাবে পাকা বাড়ির আকৃতির মধ্যে প্রবেশপথ, উপরে ওঠার সিঁড়ি, নিচতলায় গাড়ি পার্কিং, প্রতিটি তলায় আলাদা কক্ষ, দরজা-জানালা ও বাথরুম। এভাবে প্রতিটি শোপিস প্রকৃত ভবন বা স্থাপনার আদলে তৈরি করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নিপুণ কারুকাজের বিষয়টি।

নিজের চোখে কোনো স্থাপনা দেখলে কিংবা কোনো অফিস-আদালত, ভবন-বসতঘর, লঞ্চ-জাহাজ-নৌকা, উড়োজাহাজ ইত্যাদি দেখালে তিনি বাঁশ দিয়ে অবিকল সেগুলো বানাতে পারেন। বাঁশের বেতি (চেরাই অংশ), কখনো দিয়াশলাইয়ের কাঠি ছাড়াও বেল্লাল তার নান্দনিক কারুকাজে ব্যবহার করেন দা, করাত, হাতুড়ি, বাটাই (বাটালি) ও সুপারগাম। কোনো কোনো পণ্যের আসল চিত্র ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয় নানা রং। চারতলা একটি লঞ্চ তৈরি করতে তার সময় লাগে ২২ দিন এবং ঘর তৈরিতে সর্বনিম্ন ৫ দিন।

কাঠের ঘর বানাতে মজুরি ছাড়া ৮০০, লঞ্চ বানাতে মজুরি ছাড়া সাড়ে ৩ হাজার, দশতলা ভবন তৈরিতে মজুরি ছাড়া তার খরচ ২ হাজার ৬০০ টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম সুরুজ বলেন, কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া বেল্লালের হাতে তৈরি শোপিসগুলো দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবেন। সামর্থ্য থাকলে যে কেউ তার পণ্য দিয়ে ঘরের ড্রয়িং রুম সাজাতে চাইবেন।

বেল্লাল বলেন, আমার শ্রমের টাকা যদি ধরি, তাহলে এই পণ্যগুলোর দাম হবে অনেক। এতে ক্রেতারা বিমুখ হতে পারেন। তাই আমার উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামান্য কিছু টাকা পেলেই গ্রাম্য কাঠের ঘর সর্বনিম্ন ৯০০ থেকে ১৮০০ টাকা, চারতলা লঞ্চ ৬ হাজার টাকা, দশতলা ভবন সাড়ে ৪ হাজার টাকা, শহীদ মিনার ১ হাজার টাকা, নৌকা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি করছি। বিডি প্রতিদিন