উপজেলা নির্বাচনে এমপিরা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না

সারা দেশে দলীয় শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থানে গেছে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ কোনো থানা বা উপজেলা কমিটি গড়তে পারবেন না, ভাঙতেও পারবেন না। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সংসদ সদস্যরা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তৃণমূল নেতাদের কাছে এই বার্তা সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশের দলীয় নেতাদের ঢাকায় তলব করা হয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দেড় মাস পেরিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে কোন্দল এবং সংঘাত বন্ধ হয়নি। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে বহিষ্কার, নিজ দলের নেতাকর্মীদের সম্পত্তি দখল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর ভাঙচুর, মারধর, লুটপাট, এমনকি কিছু জায়গায় প্রশাসন দিয়ে হয়রানি করার ঘটনাও ঘটছে। অনেকে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন।

এমন অবস্থার মধ্যে গতকাল শনিবার রংপুর বিভাগের দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। আজ রবিবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম বিভাগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এই বৈঠক হবে।

গতকালের বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রংপুর বিভাগের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘কারো নিজের ইচ্ছায় কোনো কমিটি গঠন করতে পারবেন না। আপনারা কোনো থানা-উপজেলা কমিটি গড়তেও পারবেন না, ভাঙতেও পারবেন না। আপনাদের কোনো কথা থাকলে কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করবেন যে, এ কারণে ঐ কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আপনারা ভাঙবেন কেন? অনেক সময় দেখা যায়, উপজেলা বা থানা কমিটি ভেঙে দিয়েছে কিন্তু কেন্দ্র তা জানে না। আওয়ামী লীগে এটা হতে পারে না। নিজেরা পকেট থেকে কমিটি করবেন, পকেটের কমিটি আমরা চাই না। কমিটি করবেন দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাদের দিয়ে।’

উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা যাতে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে প্রভাব বিস্তার না করেন, সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ফ্রি স্টাইলে দল চলতে পারে না। উপজেলা নির্বাচনে এমপিরা হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে নিজের লোক জেতাতে প্রভাব বিস্তার করলে দল কোনোভাবেই তা মেনে নেবে না।

তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচন আপনাদের অনুরোধে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার স্তরে স্তরে সেতু তৈরি করতে হবে। জনগণের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। জেলার সঙ্গে উপজেলা, উপজেলার সঙ্গে ইউনিয়নের সাংগঠনিক সেতু তৈরি করতে হবে। যেখানে যেখানে ওয়াল আছে, সেগুলো ভেঙে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আপন ঘরে যার শত্রু, তার শত্রুতার জন্য বাইরের শত্রুর দরকার নাই।

এ কারণে আপন ঘরের শত্রু তাড়াতে হবে। আপন ঘরে শত্রু রেখে কোনো দিনও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য সফল হবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। কোনো সমস্যা থাকলে নিজেরা সমাধান করবেন। না পারলে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে, আমাদের নেতৃবৃন্দ আছেন। ঘরের সমস্যা আমরা ঘরেই সমাধান করব। ঘরের মধ্যে যদি আমরা একে অপরের সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করি, জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় যেমনটা হয়েছে, এর পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিযোগিতা যারা করতে চায় করুক।’

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রত্যাশা তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ইলেকশন সম্পূর্ণভাবে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার করতে চাই। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। নির্বাচনের আগে যে আশঙ্কা, আতঙ্ক ছিল, তা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে। সংগঠনে বিদ্যমান কিছু সমস্যা সমাধানে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনের পর আটঘাট বেঁধে নামবে বলেও জানান তিনি। নেতাকর্মীদের কথাবার্তায় সংযত ও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যার যেমন খুশি, যখন-তখন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য রাখবেন, সেটার দায়িত্ব দল গ্রহণ করবে না।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, সারা বিশ্ব নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছে। ৮০টি দেশ শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তার সঙ্গে ৩২টি সংস্থা অভিনন্দন জানিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি কী বলল এটা বিচার করে বাংলাদেশে রাজনীতি চলবে না। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে তাদের চিন্তাভাবনার মিল নেই। এখানে নির্বাচনে ঘাটতি কোথায়? টার্ন আউট সন্তোষজনক। নির্বাচন নিয়ে যারা একসময় কথা বলত, নিষেধাজ্ঞার প্রশ্ন ছিল, তারাও বুঝতে পেরেছে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, এই দেশের গণতন্ত্র হত্যাকারী বিএনপি এখন গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করছে। যে যাই বলুক, আমরা সঠিক পথে আছি। আর্থিক বিভিন্ন সূচকে আমাদের অবস্থা আমরা জানি। অর্থমন্ত্রীর কণ্ঠেও আশাবাদের সুর। আমাদের এখন আশঙ্কা করার কোনো কারণ নেই। আপনারা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের খেলা হয়েছে মন্তব্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এমন খেলা একাত্তরেও চলেছিল।

সেই অশুভ খেলায় একাত্তরে যেমন ভারতসহ কিছু বন্ধু দেশ পাশে ছিল, তেমনি এখনো আমাদের পাশে এসে তারা দাঁড়িয়েছে। আর এটা হলো ভারতের অপরাধ। সে জন্য ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে হবে। বর্জন করতে যারা বলে, তাদের রান্নাঘরে ভারত, ড্রেসিংরুমে ভারত, তাদের শোবারঘরে ভারতীয় পণ্য—এটাই হলো বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুর আমলে ভারতবিরোধিতার যে অশুভ খেলা হয়েছে, একই অশুভ খেলা আবার শুরু হয়েছে। সবকিছু ছাড়িয়ে বিএনপি এখন ভারতবিরোধিতায় নেমেছে। আমরা চ্যালেঞ্জিং টাইম অতিক্রম করছি। এ সময় ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী সভা সঞ্চালনা করেন। রংপুর বিভাগের অন্তর্গত সাংগঠনিক জেলাসমূহের নেতৃবৃন্দ, জাতীয় সংসদের দলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যবৃন্দ এবং দলীয় জনপ্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।

কেন্দ্রীয় নির্দেশনা উপেক্ষা করে নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মানিকসহ চার নেতাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন একই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও নোয়াখালী-২ আসনের সংসদ সদস্য। গত ৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তাদের অব্যাহতির ঘোষণা দেন তিনি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে সরাসরি কাজ করায় সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হকসহ রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকে দলীয় পদে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতারা। দেড় মাস আগে দেওয়া কারণ দর্শানো চিঠির (শোকজ) জবাব না দেওয়ায় তাদের দল থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে সম্প্রতি। সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনে নৌকার বিরোধিতা করায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের তিন নেতাকে দলের সব পদ ও কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাদের স্থায়ী বহিষ্কারের সুপারিশ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে পাঠানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে বিরোধিতা করায় গত ৮ জানুয়ারি জেলা আওয়ামী লীগের জরুরি সভায় তিন জনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবারের নির্বাচনে অন্তত ২২০টি আসনে সাড়ে তিন শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন।