এবার দেশের সবচেয়ে বড় তাজিয়া মিছিল সৈয়দপুরে

হায় হোসেন..হায় হোসেন.. মাতম তুলে প্রতিবছরের মতো এবারও তাজিয়া মিছিলের মাধ্যমে পবিত্র আশুরা পালিত নীলফামারীর সৈয়দপুরে। দিনটি পালনের জন্য শহরের বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বড় বড় তোরণ। আলোকসজ্জায় সাজানো হয়েছে নগর। ইমাম হোসেনের মাজারের মতো করে মিনারসহ তাজিয়া নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে মাতমের তালে তালে বাজানো হয় তাল-খোল-ড্রাম। অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেলা বসেছে সেখানে। নারী-পুরুষ-বয়োবৃদ্ধ সবার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ।

আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানা হয়, এই তাজিয়া মিছিলে দশ থেকে বারো হাজার মানুষ অংশ নিয়েছে। শহরের গুরুত্বপর্ণ জায়গাগুলোতে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা, তলোয়ার ও আগুনের বিভিন্ন প্রকার প্রদর্শনী হয়েছে।

জানা যায়, উপজেলা শহরের গোলাহাট থেকে শোভাযাত্রা ও মিছিল বের করে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এসময় সবার পরনে ছিল কালো পোশাক। ঢোলের তালে তালে দু’হাত দিয়ে সজোরে বুকে আঘাত করে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা। একই সঙ্গে মুখে উচ্চারিত হয় ‘ইয়া হোসেন..ইয়া হোসেন..’। অশ্রুজলে ভেসে মাতম করতে থাকে সবাই।

মাতমকারী দলের আলমগীর হোসেন (৪২) বলেন, ‘ছুড়ি-ব্লেড দিয়ে শরীর জখম করে রক্ত ঝরিয়ে মাতমের রীতি পালন করা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবারে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় হাতিখানা কবরস্থানের কাছে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা জায়গার মধ্যে নির্মাণ করা ইমাম হোসেনের কল্পিত মাজারে (যা কারবলা নামে পরিচিত) দুলদুল ঘোড়ার আদলে সাজেন পাইকরা।’

আয়োজক কমিটির প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন (৪৮) জানান, মহরমের ৭ তারিখে কারবলা থেকে কিছু মাটি আনা হয়। বিশেষ নিয়ম অনুযায়ী সে মাটি একটি পাত্রে করে তাজিয়ার নিচে সংরক্ষিত রাখা হয়। এরপর তাজিয়াকে কেন্দ্র করে চলে অন্যান্য রীতিনীতি পালন। মাটি যেখান থেকে আনা হয়েছিল আশুরার দিন সেখানেই রেখে আসা হয়। মাটি রাখার জন্য শোকের মিছিল নিয়ে যেতে হয়। কারও কারও শরীর রঙিন রশি, জরির ফিতা এবং ছোট ছোট ঘুণ্টির মালা দিয়ে পেঁচানো থাকে। প্রত্যেকের মাথায় সাদা ও সবুজ কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢাকা রাখতে হয়। হাতে লাল সবুজ আর সাদা রঙয়ের পতাকা নিয়ে হাজার হাজার লোকের মিছিলে কারবালায় (সৈয়দপুর শহরে নির্মিত অস্থায়ী কারাবলা) তিল ধরনের জায়গা থাকে না।

প্রসঙ্গত, কারবালার শোকাবহ ঘটনাবহুল এই দিনটি মুসলমানদের কাছে ধর্মীয়ভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও শোকের প্রতীকের পাশাপাশি বিশেষভাবে পবিত্র দিবসটি পালন করা হচ্ছে। নীলফামারীর বিহারী অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরে আশুরার নানা অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে প্রতিবারই পালিত হয়ে আসছে। স্থানীয়রা জানায়, ব্রিটিশ আমলে রেলওয়ে কারখানাকে কেন্দ্র করে দক্ষ জনবল নিয়োগের জন্য হাজার হাজার অবাঙ্গালিদের ভারতের বিহার রাজ্য থেকে আনা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরও তারা বংশ পরম্পরায় সৈয়দপুর শহরে বাস করে আসছেন। ধর্মীয় রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের কাছে আশুরার গুরুত্ব অনেক। যেহেতু তাদের মধ্যে শিয়া ও সুন্নি উভয় মতের অনুসারী রয়েছেন, তাই অনুষ্ঠান উদযাপনের ধরনও ভিন্ন। আশুরা উপলক্ষে তারা নানা আয়োজন ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দিনটি অতিবাহিত করে।

সৈয়দপুর থানার ওসি মো. শাহাজান পাশা জানান, অবাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকা হলেও এখানে সাম্প্রদায়িক কোনও সংঘাত নেই। ফলে শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হয়েছে পবিত্র আশুরা। নিরাপত্তার জন্য পুলিশের টহল-ভ্যান ঘুরছে। এছাড়াও বিশেষ স্থানে পুলিশ দেওয়া হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি করা হচ্ছে। ফলে এবারে আশুরায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।