কুড়িগ্রামে সাড়ে ৩ বছর বন্ধ সেতু নির্মান কাজ, দুর্ভোগে ৫ ইউনিয়নের মানুষ

তৃতীয় পক্ষের মামলা এবং ঠিকাদারের গাফিলতিতে দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছরেও শেষ হয়নি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর সড়কে জনগুরুত্বপূর্ণ শুলকুর বাজার সেতু নির্মাণ কাজ। চরম দুভোর্গে পড়েছে পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ। জনগনের কোন কাজেই আসছে না এলজিইডি কর্তৃক ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১৮ ফুট চওড়া সুদৃশ্য সংযোগ সড়কটি। নির্মাণ কাজের মেয়াদ ২ বছর পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান হয়েছে শুধুমাত্র একটি স্প্যান।

এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ সময়ে কাজ সম্পন্ন না হলেও সেতু নির্মানে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

এ অনিশ্চয়তাকে রুখতে স্থানীয় এমপি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে এলজিইডি কতৃপক্ষ সেতু পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নিলে তৃতীয় পক্ষ হাইকোর্টে মামলা করায় সেতুটি নির্মাণে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়- সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় নতুন সেতু নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে কুড়িগ্রাম এলজিইডি টেন্ডার আহ্বান করে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্মাণ কাজটি পান কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা এন্ড আবু বকর জেবি। যার সত্ত্বাধিকারী মোঃ আলতাফ হোসেন ও কে এম বদরুল আহসান(মামুন)। ৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় ছিল ৫ কোটি ৫২ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। কাজটি শুরু হয় ২০১৮ সালের ৮ আগষ্ট। যা সমাপ্তির নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলেও গত২ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সেতুর নির্মাণ কাজ। শুরু থেকে দেড় বছরে সেতুর একটি মাত্র স্প্যান নির্মাণ করা হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, কাজটি বসুন্ধরা এন্ড আবু বকর জেবি’র স্বত্বাধিকারী আলতাফ হোসেন এবং কে এম বদরুল আহসান ( মামুন) এর নামে হলেও বাস্তবে তৃতীয় পক্ষ হিসাবে অসম্পন্ন কাজটি করেন শহরের নিম বাগান এলাকার গোলাম রব্বানী। এলজিইডি’র কতিপয় কর্মকর্তার সাথে যোগসাজসে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা উত্তোলন করেছে ঠিকাদার নামধারী ওই তৃতীয় পক্ষ।

কাজ সম্পন্ন না করে কিভাবে প্রায় ২ কোটি টাকা বিল হিসেবে উত্তোলন করলো ওই ঠিকাদার এ প্রশ্ন এখন সর্বমহলের।

তাছাড়া পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াতের জন্য সেতুর বিকল্প পার্শ্ব রাস্তাটি হেরিংবোন হিসেবে করলেও ওই সাব-কন্ট্রাকটার হেরিংবোন রাস্তাটির প্রায় ৫ হাজার ইট তুলে নিয়ে গেছেন। ফলে গত বন্যায় রাস্তাটি ভেঙে গেলে প্রতিদিন হাজারো মানুষের চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। সেই সাথে সেতুটি না থাকায় উত্তরবঙ্গের বৃহৎ যাত্রাপুর গরুর হাট, সদর উপজেলার পাঁচগাছী, যাত্রাপুর, ঘোগাদহ, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নসহ সীমান্তবর্তী অসংখ্য হাট-বাজারে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত সম্পূর্ণরুপে বন্ধ রয়েছে। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

শুলকুর বাজারের ব্যবসায়ী মোফাচ্ছেল হোসেন বলেন, সকল ব্যবসায়ীকে পণ্য আনা নেওয়ার কাজে দুভোর্গ পোহাতে হচ্ছে এবং বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছি। কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও সেতটিু এভাবেই পরে আছে। যেন দেখার কেউ নেই। বিকল্প রাস্তাটি খানাখন্দরে ভরে থাকার ফলে অনেক সময় যানবাহন উল্টে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অনেকেই।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে এলজিইডি-র নির্বাহী প্রকৌশলী সেতুটির কাজ সমাপ্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন কিন্তু ঠিকাদারে অসহযোগিতা ও গাফিলতির কারণে সেতুটির কাজ সমাপ্ত হয়নি।

পাঁচগাছী ছত্রপুর গ্রামের মোজাহার জানান- পানি বাড়ার সাথে সাথেই ব্রিজের পার্শ্ব রাস্তাটি ডুবে যাবার উপক্রম হয়। বৃষ্টির হলে রাস্তায় কাদা জমে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। সহজে রিকসা, ভ্যান, অটোরিকসা, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য ছোট যানবাহন যাতায়াত করতে পরছেনা। প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। বিকল্প রাস্তাটি তলিয়ে গেলে এলাকাবাসীকে অতিরিক্ত নৌকা ভাড়া দিয়ে পার হতে হতো। আমরা ৫ ইউনিয়নের মানুষ এই ব্রিজের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। কাজ বন্ধ করে দিয়ে ঠিকাদার গোলাম রব্বানী আজ পর্যন্ত এখানে আসেনি।

যাত্রাপুর এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন বলেন, প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে ব্রিজের সামান্য কাজ করে বন্ধ রাখা হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বৃহৎ যাত্রাপুরহাটসহ আশেপাশের অনেক হাট বাজারে পণ্য আনা নেওয়া প্রায় বন্ধের উপক্রম। ফলে এসব হাটবাজার থেকে সরকার রাজস্ব হারাতে বসেছে।

কুড়িগ্রাম শহরের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, বর্ষা মৌসুমে মানুষের কষ্টের কথা বিবেচনা করে আমি ঠিকাদারকে বহুবার সেতু নির্মাণের কাজটি শুরু করার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু ঠিকাদার গোলাম রব্বানী কোনো গুরুত্ব না দিয়ে জানান এখনো অনেক সময় আছে। নির্মাণ কাজ দ্রুত শুরু করা না হলে প্রয়োজনে আমরা এলাকাবাসী মানববন্ধন করবো ও প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিবো।

এব্যাপারে ওই ব্রিজের কাজ করা তৃতীয়পক্ষ গোলাম রব্বানী জানান, চাহিদা অনুযায়ী বিল প্রদানে বিলম্ব ও কাজ বাতিল করায় আমি হাইকোর্টে রিট করেছি।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা এন্ড আবু বকর জেবি’র স্বত্বাধিকারী কে এম বদরুল হাসান (মামুন) জানান, আর্থিক সমস্যার কারণে চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো কাজটি সম্পন্ন করতে পারিনি। আদালতে আমরা কোনো রিট করিনি। হাইকোর্টে রিটের কথা জানতে পেরে থানায় জিডি করেছি।

ওই প্রতিষ্ঠানের আরেক স্বত্বাধিকারী আলতাফ হোসেন জানান, বিধিসম্মত ভাবে কাজ বাতিলের বিষয়ে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। তবে আমাদের সম্পন্নকৃত কাজের সঠিক বিল চাই। জনদুর্ভোগ লাঘবে কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে আমরা মেনে নেবো। যার আবেদন ইতিমধ্যে এলজিইডি অফিসে দাখিল করেছি।

কুড়িগ্রাম এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে সেতুর কাজ শেষ করতে পারেনি। ইতোমধ্যে প্রথমবার কাজ সমাপ্তির সময় শেষ হলেও আবারও সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। চলতি বছরের ২ জুন কাজ সমাপ্তির শেষদিন ছিলো।

তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮ ফুট চওড়া সংযোগ সড়ক নির্মাণ হলেও সেতুটির কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এর সুফল জনগন পাচ্ছে না। জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে যথাযথভাবে আগের টেন্ডার বাতিল করে নুতন টেন্ডারের কার্যক্রম শুরুর আগেই হাইকোর্টের নির্দেশনায় সেতু নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মন্জু বলেন, বর্তমান ঠিকাদার দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। নুতন ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে জনগণের দুভোর্গ নিরসনে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে তাগাদা দেয়া হয়েছে ।

কুড়িগ্রাম-২ আসনের এমপি আলহাজ্ব পনির উদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণের দূর্ভোগ লাঘবে নুতন ঠিকাদার নিয়োগ করে এলজিইডি’র প্রকৌশলীকে সেতুর নির্মাণের কাজ দ্রæত সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এলজিইডি অতিসত্বর কাজটি সম্পন্ন করবে বলে জানিয়েছে।