কৃষিজাত পন্য ফল ও ফসলের উশর-যাকাত

হযরত মাওলানা মুহম্মদ আবুল বাশারঃ সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য।সাইয়্যিদুল মুরসালীন নূরে মুজাসসাম হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি অফুরন্ত দুরুদ শরীফ ও সালাম। উশর শব্দটি আরবী আশরাতুন (দশ) শব্দ হতে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ হলো এক দশমাংশ। সম্মানিত শরীয়ত উনার পরিভাষায় কৃষিজাত পণ্য- ফল ও ফসলের যাকাতকে উশর বলে।

উশর সম্পর্কে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার একাধিক পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা তিনি ইরশাদ করেন,-অর্থ: তোমরা তোমাদের উপার্জিত হালাল সম্পদ হতে এবং যা আমি তোমাদের জন্য যমীন হতে উৎপন্ন করিয়েছে তা থেকে দান করো। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২৬৭)তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-অর্থ: ফসল কাটার সময় তার হক (পবিত্র উশর) আদায় করো। (পবিত্র সূরা আনআম শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪১)পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র উশর সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে-অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যাতে অর্থাৎ যে যমীনকে আসমান অথবা প্রবাহমান কূপ পানি দান করে অথবা যা নালা দ্বারা সিক্ত হয়, তাতে পবিত্র উশর অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ আর যা সেচ দ্বারা সিক্ত হয়, তাতে অর্ধ উশর অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ।

(বুখারী শরীফ)সম্মানিত হানাফী মাযহাব উনার ইমাম হযরত ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, যমীনে উৎপন্ন যাবতীয় ফসলেরই উশর অথবা নিছফু উশর দিতে হবে। চাই দীর্ঘস্থায়ী শস্য হোক, চাই ক্ষণস্থায়ী শস্য অর্থাৎ শাক-সবজি হোক। তিনি আরো বলেন, কম-বেশি যাই হোক উশর আদায় করতে হবে।উশর আদায়ের সময়: পবিত্র উশর আদায়ের নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। যতবারই ফসল উৎপন্ন হবে ততবারই ফসলের যাকাত তথা উশর দিতে হবে।

উশর প্রদানকারী:যে বা যারা ফসলের মালিক হবে সে বা তারাই উশর প্রদান করবে।উশর ব্যয়ের খাতসমূহ:যে খাতে বা স্থানে যাকাত ব্যয় করতে হয়, সে খাত বা স্থানেই উশর ব্যয় করতে হবে।

উশরের নিছাব:সম্মানিত হানাফী মাযহাব মতে পবিত্র উশরের কোন নিছাব নেই। বিনা পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসল ও ফল ফলাদির দশ ভাগের এক ভাগ বা তার মূল্য দান করে দিতে হবে। আর পরিশ্রম করে ফসল বা ফল ফলাদি ফলানো হলে তখন বিশ ভাগের এক ভাগ বা তার মূল্য দান করে দিতে হবে। ধান, চাল, গম ব্যতীত ফল-ফলাদির ১০টির ১টি বা ২০টির একটি দিতে হবে। আর যদি ৫টি হয় তবে একটার অর্ধেক দিতে হবে।উশর আদায়ের হুকুম:

ফসলের যাকাত হচ্ছে উশর, যে উশর আদায় করলো সে তার ফসলের যাকাত আদায় করলো। যে উশর আদায় করলো না, সে তার ফসলের যাকাত আদায় করলো না। কাজেই, টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-চান্দির যাকাত আদায় করা যেরূপ ফরয জমির উৎপাদিত ফসল ও ফল-ফলাদির যাকাত (উশর) আদায় করাও তদ্রƒপ ফরয। অতএব, কেউ যদি ফসলের যাকাত (উশর) আদায় না করে তাহলে সে ফরয অনাদায়ের গুনাহে গুনাহগার হবে।কর ও খাজনা প্রদানকৃত যমীনের ফসলে উশর দেয়ার হুকুম:কর ও খাজনা প্রদানকৃত যমীনের ফসলেও উশর আদায় করতে হবে। কেননা কর ও খাজনা দেয়া হয় সরকারি খাতে জমি জরিপ ও দেখাশুনা করার জন্য। অনেক জমিতে ফসল না হলেও খাজনা দিতে হয়। আবার পূর্ব যামানায় জমিতে খাজনাও দিতে হতো না। অতএব, কর ও খাজনা প্রদানকৃত যমীনের ফসলেও পবিত্র উশর আদায় করতে হবে। যা ফরযের অন্তর্ভুক্ত।

উশর আদায়ের উদাহরণ:
কারো যমীনে পরিশ্রমের মাধ্যমে ৫০ মণ ধান উৎপন্ন হলো সে নিছফু উশর অর্থাৎ বিশ ভাগের ১ ভাগ উশর প্রদান করবে, অর্থাৎ আড়াই মণ ধান প্রদান করবে। আর যদি বিনা পরিশ্রমে উৎপন্ন হয় তাহলে উশর তথা দশভাগের একভাগ ধান প্রদান করবে, অর্থাৎ ৫ মণ ধান পবিত্র যাকাত বা উশর হিসেবে আদায় করবে।উশর আদায়ের ফযীলত:যাকাত দিলে যেমন সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং পবিত্র হয়, তদ্রুপ পবিত্র উশর আদায় করলেও ফসল, ফল-ফলাদি বৃদ্ধি পায় ও পবিত্র হয়। সাথে সাথে বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ যেমন- ঝড়-তুফান, বন্যা-খরা, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ইত্যাদি থেকেও ফসল ও ফল-ফলাদি হিফাযত হয়। সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক সুবহানাহূ ওয়া তায়ালা তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-অর্থ: হে আদম সন্তান! তুমি দান করো; আমি তোমাকে দান করবো। (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে পূর্ববর্তী (বণী ইসরাঈল) যামানার একটি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। তা হলো, “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, এক ব্যক্তি এক মাঠে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় তিনি মেঘের মধ্যে এক শব্দ শুনতে পেলেন যে, অমুকের বাগানে পানি দাও। অতঃপর মেঘমালা সেই দিকে ধাবিত হলো এবং এক প্রস্তরময় স্থানে পানি বর্ষণ করলো। তখন দেখা গেলো, সেখানকার নালাসমূহের এক নালা সমস্ত পানি নিজের মধ্যে ভর্তি করে নিলো। তখন সে ব্যক্তি পানির অনুসরণ করলেন এবং দেখলেন যে, এক ব্যক্তি উনার বাগানে দাঁড়িয়ে সেচুনী দ্বারা পানি সেচতেছেন। তখন তিনি উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে মহান আল্লাহ তায়ালা উনার বান্দা!

আপনার নাম কি? তিনি বললেন, আমার নাম অমুক- যে নাম তিনি মেঘের মধ্যে শুনেছিলেন সে নাম। তখন এ ব্যক্তি বললেন, হে মহান আল্লাহ তায়ালা উনার বান্দা! আপনি কেন আমাকে আমার নাম জিজ্ঞাসা করলেন? তিনি বললেন, যেই মেঘের এই পানি সেই মেঘের মধ্যে আমি একটি শব্দ শুনেছি। আপনার নাম নিয়ে বলা হয়েছে যে, অমুকের বাগানে পানি দাও। (তিনি আরো বললেন, হে মহান আল্লাহ তায়ালা উনার বান্দা!) আপনি ফসলের দ্বারা কি কি কাজ করেন। তিনি উত্তরে বললেন, যখন আপনি জানতে চাইলেন তখন শুনুন, এই জমিতে যা ফলে তা আমি তিন ভাগ করি। এক ভাগ দান করি, এক ভাগ আমি ও আমার পরিবারের খাবারের জন্য রাখি এবং অপর ভাগ ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যয় করি।

(মুসলিম শরীফ, মিশকাতুল মাছাবীহ কিতাবুয যাকাত বাবুল ইনফাক্বা ওয়া কারাহিয়াতিল ইমসাক)অতএব, প্রমাণিত হলো যে, কেউ যদি তার যমীন থেকে উৎপাদিত ফসল ও ফল-ফলাদির যথাযথ হক্ব আদায় করে অর্থাৎ যাকাত বা উশর আদায় করে এবং দান-ছদকা করে তাহলে মহান আল্লাহ পাক তিনি কুদরতীভাবেই তার ফসলের হিফাযত করবেন এবং তার ফসলে বরকত দান করবেন। তার ফসল কখনো নষ্ট হবে না।

সুবহানাল্লাহ!উশর (ফসলের যাকাত) আদায় না করার শাস্তি:হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যাকে মহান আল্লাহ পাক তিনি সম্পদ বা ফসল দান করেছেন আর সে তার পবিত্র যাকাত বা উশর আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা সাপ স্বরূপ বানানো হবে, যার চক্ষুর উপর কিসমিসের দানার মতো দুটি কালো বিন্দু থাকবে। কিয়ামতের দিন সাপটাকে তার গলায় বেড়ি স্বরূপ পড়ানো হবে। অতঃপর উক্ত সাপ তার মুখের দু’দিকে কামড় দিতে থাকবে আর বলবে, আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ, আমি তোমার মাল।

(বুখারী শরীফ)
অতএব, প্রত্যেক ব্যক্তিরই উচিত যমীনে উৎপাদিত ফসলের পবিত্র যাকাত বা উশর আদায়ের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মতে মত ও পথে পথ হয়ে হাক্বীক্বী রিযামন্দী মুবারক হাসিল করা।