কেন ঈদে শত ভোগান্তি ঠেলে গ্রামে ছোটেন নগরবাসী

ঈদে নগরবাসী, বিশেষ করে ঢাকার বাসিন্দারা গ্রামের বাড়ি যান৷ এই যাত্রায় যত ভোগান্তিই থাকুক, সবাই তা মেনে নেন৷

ঈদে কত লোক ঢাকা ছাড়েন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই৷ তবে কমপক্ষে অর্ধেক নগরবাসী যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই৷ সেই হিসেবে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই শহরের ৮০-৮৫ লাখ মানুষ এবারের ঈদেও ঢাকা ছাড়বেন৷

এরই মধ্যে নগরবাসী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন৷ কেউ কেউ আবার ঈদ যাত্রার ভোগান্তি কিছুটা কমাতে আগেই স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ নিজেরা যাবেন ঈদের ছুটি শুরু হলে৷

লম্বা ছুটি!

ঈদের সরকারি ছুটি ৪, ৫ ও ৬ জুন৷ কিন্তু শুক্রবার ( ৩১ মে) থেকেই বাস্তবে ছুটি শুরু হয়ে যাচ্ছে, কারণ, শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি৷ রবিবার শবে কদরের সরকারি ছুটি৷ তারপর মাত্র সোমবার (৩ জুন) অফিস খোলা৷ এরপর থেকে টানা ৩ দিন ঈদের ছুটি৷ ফলে সোমবার অনেকেই ঐচ্ছিক ছুটি নিয়েছেন বা ‘অন্যভাবে ম্যানেজ’ করছেন৷ তাই ধরে নেয়া যায় শুক্রবার থেকেই ঢাকার মানুষ গ্রামে ছুটতে শুরু করবেন৷

আর ধারণা করা হচ্ছে এবার আগের তুলনায় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়বে৷ কারণ, ঈদের ছুটি শেষে দুই দিন শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি আছে৷ তাই সব মিলিয়ে হিসাব করলে এবার ঈদে ছুটি ৯ দিন৷

কেন সবাই গ্রামে যান?

ঢাকার বেসরকারি চাকরিজীবী জামাল উদ্দিন৷ তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গত ঈদে ছুটি পাইনি, তাই বাড়ি যেতে পারিনি৷ এবার ছুটি পেয়েছি৷ সব মিলিয়ে ৯ দিন ছুটি৷ তাই বাড়ি যাবো৷ স্ত্রী-পরিজনকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি ভোগান্তি এড়াতে৷ আমি যাবো ছুটি শুরু হলে৷’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘গ্রামে আত্মীয়-স্বজন আছে, তাঁদের সাথে দেখা হবে৷ পরিবারের অন্যরাও আছেন৷ তাই যাওয়া-আসায় ভোগান্তি হলেও আনন্দ তার চেয়ে বেশি৷’’

ফওজিয়া সুলতানা একাই ঢাকায় থাকেন৷ কাজ করেন একটি সংবাদ মাধ্যমে৷ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা৷ তিনি যে করেই হোক প্রতি ঈদেই গ্রামের বাড়ি যান৷

কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাই-কোন বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেন৷ দেশের বাইরেও আত্মীয়-স্বজন আছেন৷ তাঁরা সবাই ঈদে গ্রামে আসেন৷ আর কোনো জায়গায় এমরা একসাথে এভাবে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাই না৷ তাই আমি ঈদে সব সময় বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করি৷ এ পর্যন্ত আমার কোনো ঈদই মিস হয়নি৷ এটা আমার নাড়ির টান৷’’

সরকারি কর্মকর্তা খাদেমুল করিম ইকবাল বলেন, ‘‘আমি টানা ৯ দিন ছুটি পাচ্ছি না৷ ৩ জুন অফিস করে আমাকে যেতে হবে৷ কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা নেই৷ আমার যেখানে জন্ম, সেই জামালপুরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করবো৷ ওটাই আমার বাড়ি৷ ওখানে আমার সব স্মৃতি৷ আমি গ্রামের বাড়ি ছাড়া ঈদ করার কথা চিন্তাই করতে পারি না৷’’

কারা বাড়ি যান?

তাই ঈদ শুধু উৎসব নয়৷ নগরবাসীর কাছে নাড়ির টানে গ্রামে ফেরার এক আয়োজন৷ আর ওই গ্রামে ফিরে আসেন পরিবারের সবাই৷ অনেকেই এই মিলনমেলা মিস করতে চান না৷

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই উৎসব আয়োজনে গগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার নানা কারণ আছে৷ এখনো ঢাকার ৬০ ভাগ পরিবার প্রধানের জন্ম গ্রামে৷ আবার ঢাকায় যাঁরা মাইগ্র্যান্ট, তাঁদের অধিকাংশের শহরে বাড়ি নেই৷ তাঁদের পরিবারের একটি অংশ নিজ গ্রামে বা অন্য এলাকায় কাজের জন্য থাকেন৷ কেউ আছেন, যিনি শুধু নিজেই ঢাকায় থাকেন, পরিবার গ্রামে থাকেন৷ এসব কারণে উৎসব আয়োজনে তাঁরা গ্রামে যান৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘মধ্যবিত্তের একটি অংশ আছে যাদের গ্রাম ও শহর উভয় জায়গায় বাড়ি আছে৷ তাঁরাও গ্রামে তাঁদের পরিবার নিয়ে যার গ্রাম দেখাতে৷ কিন্তু যাঁদের গ্রামে বা শহরে কোথাও বাড়ি নেই, তাঁরা আসলে যান না৷ এঁরা নিম্নবিত্ত মানুষ৷ তাঁরা ঢাকায় হয়ত বস্তিতে থাকেন৷ গ্রামে কোনো আশ্রয় নেই৷ সে কারণেই শহরে এসেছেন৷’’

এই নগর বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘‘ঢাকার ৪০-৫০ ভাগ মানুষ ঈদে গ্রামে যান৷ তবে কোনো জরিপ নেই৷ এটার একটি জরিপ হলে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে৷’’

সারাদেশে কত লোক ঈদে গ্রামে যান?

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ঈদের সময়ে সারাদেশে কমপক্ষে দ্বিগুন মানুষ যানবাহনে চলাচল করেন৷ ঢাকা থেকে এই সংখ্যা প্রায় ১ কোটি৷ আর অন্যান্য এলাকা থেকে সাড়ে ৩ কোটি৷ বাংলাদেশের সড়ক এবং যানবাহন এমনিতেই যাত্রীবান্ধব নয়৷ যানবাহন প্রয়োজনের তুলনায় কম৷ সড়কগুলোও ভালো না৷ ফলে দ্বিগুন চাপে পারিস্থিতি স্বাভাবিক কারণেই ঈদ বা কোরবানির সময় খারাপ হয়৷ সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘তবে আমরা মনে করি, এবার ঈদে যাত্রীদের ভোগন্তি কম হবে৷ আগের তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ কম৷ কারণ সড়ক- মহাসড়কের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো৷ আর মহাসড়কের কিছু এলাকায় যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ এখন যানবাহনগুলো যদি ঠিক সময়ে ছাড়ে তাহলে পরিস্থিতির আরো একটি উন্নতি হবে৷’’