খাগড়াছড়ির বাবুই পাখির শৈল্পিক প্রকৃতি দৃষ্টিনন্দন বাসা হারিয়ে যাচ্ছে

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বাবুই পাখির শৈল্পিক প্রকৃতি দৃষ্টিনন্দন বাসা হারিয়ে যেতে বসেছে। ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে’।

কবি রজনীকান্ত সেনের ছড়াটির নায়ক নিপুণ বাসা তৈরির কারিগর বাবুই পাখি। এ যুগের শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখির শিল্প নিপুণতার কথা জানতে পারবে সেই কবিতাটি পড়ে। কারণ এখন আর চোখে পড়ে না বাবুই পাখি ও তার নিজের তৈরি দৃষ্টিনন্দন সেই ছোট্ট বাসা তৈরির নৈসর্গিক দৃশ্য।

সেই ছোট্ট বাসা তৈরির নৈসর্গিক দৃশ্য হারিয়ে যেতে বসেছে বাবুই পাখি ও তার শৈল্পিক বাসা। মূলত তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় আবাস সংকটে পড়েছে বাবুই পাখি। প্রকৃতির ভারসাম্য ধরে রাখতে এ বুননশিল্পী পাখি ও তার শিল্প টিকিয়ে রাখা দরকার।

জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলায় বিভিন্ন স্থানে একসময় তিন প্রজাতির বাবুই পাখি দেখা যেত। এরমধ্যে বাংলা ও দাগি বাবুই এখন বিলুপ্তির পথে। টিকে আছে কিছু দেশি বাবুই। বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখির পছন্দের তাল, নারিকেল, সুপারি ও খেজুর গাছ কমতে থাকায় আবাসস্থল সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও কৃষিকাজে কীটনাশক ব্যবহার করায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এ পাখি। তালগাছ আর বাবুই পাখির বাসা এ যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে নিয়ে ভাবা যায় না। শুধু তালগাছকে নিয়ে ভাবলে, বাবুই পাখির বাসা এমনিতেই যেন চোখে ভেসে আসে।

অথচ এক সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে সারি সারি উঁচু তালগাছ দেখা যেত। আর সেই তালগাছের পাতায় পাতায় দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো ফুটিয়ে তুলতো। দেখে মনে হতো তাল গাছ যেন তার কানে দুল পড়ে আছে। কিন্তু এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সেই দৃষ্টিনন্দন পাখি, তার বাসা, বাসা তৈরির নৈসর্গিক দৃশ্য ও গ্রামের ঐহিত্যবাহী তালগাছ এ দুটোই আজ বিলুপ্তির পথে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এক সময় যেসব গ্রামে সারিসারি তালগাছ ছিল, সেইসব তালগাছের পাতায় পাতায় মোড়ানো থাকতো বাবুই পাখির বাসা। পাশাপাশি পাখির কিচিরমিচির শব্দে গ্রামাঞ্চল মুখরিত থাকতো। সেইসব গ্রামে এখন আর তালগাছও নেই, নেই তেমন বাবুই পাখির বাসা। ১(এক) যুগ আগেও গ্রামের রাস্তা-ঘাট, পুকুরপাড় ও মাঠের মধ্যে সারিসারি তালগাছ ছিল। কৃষকের ধান গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবুই পাখিরা তাল গাছে বাসা বাঁধতে শুরু করতো। ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাসায় নিজেদের সংসারে নতুন পাখির জন্ম হতো। বিলুপ্ত হতে হতে এভাবে করে এখনো দু এক স্থানে বাবুই পাখি বাসা বাঁধতে শুরু করে।
তেমনি ভাবে মাটিরাঙ্গার মাস্টার পাড়া এলাকায় এক পাহাড়ী আভাস্থলের একটি বড় তাল গাছে দেখা মিলল দৃষ্টিনন্দন বাবুই পাখির বাসা। ওই তাল গাছে প্রায় ৫০টি বাসা বাঁধে বাবুই পাখিরা। তাদের কিচির মিচির শব্দে জানান দেয় চড়পাড়ার কৃষকের ঘরে ধান আসার আগমনী বার্তা প্রতিদিন গ্রামের ছেলেমেয়েরা বাসা দেখতে আসে এখানে। তাদের এখানে আসার আরেক উদ্দ্যেশ্য আছে। অদক্ষতা ও নতুন কারিগর পাখির বানানো দুএকটা বাসা বাতাসে নিচে পড়ে গেলে এলাকার ছেলেমেয়েরা তা কুড়িয়ে নিয়ে খেলা করে।

এলাকার গুনিজন সচেতনরা মনে করেন, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, কীটনাশকের অপব্যবহার, শিকারিদের দৌরাত্ম, অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ, মানববসতি বাড়ায় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে তালগাছ ও এ পাখি বিলুপ্ত হতে বসেছে। তবে মাটিরাঙ্গা উপজেলার পাকা সড়ক ও গ্রাম অঞ্চলের পাশে তালগাছে রোপণ করা হলে বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা দেখা যেতো। যা একনজর দেখতে পথচারী ও শিক্ষার্থীরা একটু হলেও থমকে দাঁড়াতো।

খাগড়াছড়ি সরকারি ডিগ্রি কলেজে’র রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মধু মংগল চাকমা বলেন, আত্মনিভরশীলতার প্রতীক প্রকৃতির সুন্দর সৃষ্টি বাবুই পাখি টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রকৃতির ধ্বংসের কারনে পরিবেশ অনুকুল থাকায় অকারনে বিদ্যুৎ চমকানো, পাহাড় ধ্বস হওয়া ও প্রচন্ড গরম পড়া ইত্যাদি। এজন্য বেশি করে তাল, খেজুর ও নারকেল গাছ রোপণ করতে হবে। সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া না হলে বাবুই পাখির বাসা তৈরির গল্প শুধু বই-পুস্তকেই থেকে যাবে।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো: আমজাদ হোসেন বলেন, সব বন্যপ্রাণীই একটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বাস করে থাকে। মানুষের কোলাহল থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। জলবায়ু পরিবর্তন ও জনবসতি বাড়ায় গ্রামাঞ্চলে বড়বড় গাছপালাসহ জঙ্গল কেটে অপরিকল্পিত বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে বাবুই পাখিসহ সব শ্রেণির বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নষ্ট হচ্ছে। একারণেই মূলত গাছ ও বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।