গায়ে আগুন দেওয়া সেই মাদ্রাসাছাত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক

অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা যৌন হয়রানির মামলা তুলে না নেওয়ায় কেরোসিন ঢেলে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে ঝলসে যাওয়া মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির (১৮) অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

রোববার সকালে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘মেয়েটির শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার ব্যাপারে চিকিৎসকরা এখনও কিছু বলতে পারছে না। মেয়েটির চিকিৎসা চলছে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।’

ফেনী জেলার সোনাগাজীর সেই মাদ্রাসাছাত্রীর ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, ‘আজ সকালে বোনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তখন তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক দেওয়া ছিল। সে পানি খেতে চেয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকের নিষেধ থাকায় পানি দেওয়া যায়নি। তার অবস্থা গতকালের মতোই আছে।’

তিনি জানান, শনিবার সকালে নুসরাতের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা ছিল। তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যান তিনি। তবে কেন্দ্রের প্রধান ফটকে নোমানকে আটকে দেন নিরাপত্তাকর্মী মোস্তফা। এর পর নুসরাত একাই হেঁটে কেন্দ্রে প্রবেশ করে। এসময় নোমান কেন্দ্রে থেকে একটু দূরে চলে আসেন। এর ১৫-২০ মিনিট পরই মোবাইলে নুসরাতের অগ্নিদগ্ধের খবর পান তিনি। এর পর ফের কেন্দ্রে ছুটে গিয়ে বোনকে দগ্ধ অবস্থায় দেখতে পান নোমান।

নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। পথে নুসরাতের কাছে তার ভাইয়েরা ঘটনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় গাড়িতে বসে নুসরাত ঘটনার বর্ণনা দেন। তা মোবাইলে রেকর্ড করেন তার ভাইয়েরা।

নুসরাতের বক্তব্যের বরাত দিয়ে তার চাচাতো ভাই মোহাম্মদ আলী বলেন, নুসরাত পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে তার সিটে প্রবেশপত্র রাখেন। এসময় বোরকা পরা এক ছাত্রী নুসরাতকে জানায়, তার বান্ধবী নিশাতকে পাশের সাইক্লোন সেন্টারে মারধর করা হচ্ছে। এ কথা শুনে নুসরাত সেখানে যাওয়ার পর চারজন বোরকা পরা মানুষ তার হাত ধরে ফেলে। তাদের পরনে হাতমোজা এবং চোখে কালো চশমা ছিল। তারা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে বলে। হুজুরের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা বলতে বলে।

কিন্তু এ কথার বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে তারা নুসরাতের হাত ধরে গ্লাসে থাকা তরল পদার্থ গায়ে ছুড়ে মারে। এর পর আগুন ধরিয়ে দেয়। নুসরাতের শরীরে আগুন ধরে গেলে সে সিঁড়ি বেয়ে দৌঁড়ে চিৎকার করে নিচে নেমে আসে। এ সময় শিক্ষার্থী, কেন্দ্রের নিরাপত্তাকর্মীরা পানি ও মাটি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে।

এর পর নুসরাতকে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কপপ্লেক্স, ফেনী সদর হাসপাতাল হয়ে বিকেলে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় বলে জানান মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ঢাকায় নিয়ে আসার সময় গাড়িতে বসে নুসরাত চারজন বোরকা পরা লোকের কথা বলেছে। তবে হাতমোজা ও চোখে চশমা থাকায় সে কাউকে চিনতে পারেনি।

মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা আমাদের কোনো আশ্বাস দিতে পারেননি। তারা আল্লাহকে ডাকতে বলছেন। আমরা সবাই অসহায়। আমরা ওই অধ্যক্ষের বিষয়টি এলাকার চেয়ারম্যান, এমপি সবাইকে জানিয়েছিলাম। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ছিলাম। আমাদের বিভিন্নভাবে মামলা তুলে নেওয়ার চাপ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যেই নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হলো।’

এ ব্যাপারে সোনাগাজী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সাইকুল আহমদ ভুঁইয়া বলেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ঘটনার সময় পরীক্ষা চলছিল, সেখানে বাইরের কারও প্রবেশের সুযোগ ছিল না। কারা বা কীভাবে মেয়েটির গায়ে আগুন লাগালো তা স্পষ্ট না। মেয়েটি কথা বলতে পারছে না। তবে সে নাকি চারজন বোরকা পরা লোক দেখেছিল বলে ফেনী হাসপাতালে থাকা অবস্থায় বলেছে।

ঘটনার পর নুসরাতের বান্ধবী নিশাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। তাকে কেউ মারধর করেনি বলে জানিয়েছেন তিনি। কারা নুসরাতকে খবর দিয়েছিল, তাও জানাতে পারেননি পুলিশ সুপার।

প্রসঙ্গত, নসরাত সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরছান্দিয়া গ্রামের মাওলানা মুসা মিয়ার মেয়ে। গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে যৌন হয়রানির অভিযোগে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন।