জীবনকথা: চিরদিনের মহানায়ক উত্তম কুমার

বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারই একমাত্র অভিনেতা, যার অভিনয়ে চিরদিনই মুগ্ধ হবেন দর্শক। আর এ কারণেই তাকে বলা হয় চিরঞ্জীব মহানায়ক। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ঠাঁই করে নেয়া বাঙালি এ অভিনেতার জীবনকথা লিখেছেন সেলিম কামাল

ভুবনভোলানো হাসি, অকৃত্রিম রোমান্টিক চোখের দৃষ্টি আর অতুলনীয় অভিনয়ের গুণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও বাঙালি দর্শকদের হৃদয়ের কুঠুরিতে তিনি মহানায়ক। ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে শুরু আর ১৯৮০ সালে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবিতে অভিনয় করার সময় জীবনাবসান। মাত্র ৫৪ বছরের ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমার চলচ্চিত্র শিল্পকে দিয়েছেন ব্যস্ততম ৩২টি বছর।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার ৫১ আজিরী টোলা স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। দাদু আদর করে তাকে ডাকতেন উত্তম। আসল নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। বাবার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। মা চপলা দেবী। অভাব-অনটনের মধ্যে কাটে উত্তমের ছেলেবেলা। কিন্তু যার জন্মই হয়েছে আকাশ ছোঁয়ার জন্য দারিদ্র্য কি পারে তাকে দমিয়ে রাখতে? অভিনয় জগতে আসার পেছনে তার পরিবারের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সংস্কৃতিমনা উত্তমের বাবা-চাচারা পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘সুহৃদ সমাজ’। বিভিন্ন উৎসবে সুহৃদ সমাজ থেকে যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। যাত্রাপালায় অভিনয় দেখে উত্তমেরও অভিনয়ের ইচ্ছে জাগে। স্কুলে থাকতেই উত্তম কুমার তার মহল্লায় নাট্যসংগঠন লুনার ক্লাবে জড়িয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুকুট’ নাটিকায় অভিনয় দিয়ে শুরু হয় মহানায়কের অভিনয় জীবন।

সিনেমার ভূত যখন মাথায়

উত্তমের মাথায় চেপে বসল সিনেমার ভূত। তখনকার দিনে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে গান জানা অপরিহার্য ছিল। সে সময় অনেক নামি-দামি শিল্পী যেমন- কানন দেবী, অমিতবরণ, রবীন মজুমদার, পাহাড়ী স্যান্নাল, কুন্দন লাল সায়গল সবাই গান জানতেন। উত্তম কুমার তাই গান শিখতে কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীত শিক্ষক নিদান ব্যানার্জির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

সংসারে অভাব থাকায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি দিনে পোর্ট কমিশনার্স অফিসের ক্যাশ বিভাগে চাকরি নেন। আর রাতে ভর্তি হন ডালহৌসির গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। তিনি ১৯৪৫ সালে বিকম পাস করেন।

এক টাকা চার আনা সম্মানী

উত্তমের মাথা থেকে অভিনয়ের ভূত তখনও নামেনি। একদিন গেলেন ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওতে। সেখানে ভোলানাথ আর্য্য ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করছেন। দারোয়ান ঢুকতে না দিলে পূর্ব পরিচিত নাট্যজন

গণেশ বাবুর পরিচয় দিয়ে প্রযোজকের সামনে হাজির হলেন।

প্রযোজক অনেক দেখেশুনে তাকে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। নতুন বরের মার খাওয়ার দৃশ্যে উত্তমের অভিনয় ছিল খুবই সাবলীল। এভাবে সহশিল্পীর মর্যাদা নিয়ে মহানায়ক উত্তম কুমার চলচ্চিত্র অঙ্গনে পা রাখেন।

পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি দৈনিক এক টাকা চার আনা সম্মানী পান। কিন্তু তার প্রথম অভিনীত ছবি আর পরবর্তী সময়ে মুক্তি পায়নি। ১৯৪৮ সালে মাত্র সাতাশ টাকা পারিশ্রমিকে নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে উত্তম কুমার নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। এটিই তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি।

সুচিত্রা সেনের সঙ্গে

সাড়ে চুয়াত্তর মুক্তি পাওয়ার পর উত্তম কুমার চলচ্চিত্র জগতে স্থায়ী আসন লাভ করেন। এ ছবিতেই প্রথম সুচিত্রা সেনের বিপরীতে তিনি অভিনয় করেন। সবচেয়ে

জনপ্রিয় ও সফল

উত্তম-সুচিত্রা জুটির সূত্রপাত হয়। তাদের উল্লেখযোগ্য ছবি হল- হারানো সুর, পথে হল দেরি, সপ্তপদী, চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, জীবন তৃষ্ণা, সাগরিকা, প্রিয় বান্ধবী, হার মানা হার, আলো আমার আলো, নবরাগ, কমললতা, গৃহদাহ, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, চন্দ্রনাথ, সবার উপরে, গৃহপ্রবেশ, মরণের পরে ইত্যাদি।

হিন্দি ছবিতে উত্তম

উত্তম কুমার বহু সফল বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ১৫টি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবি

উত্তম কুমারের অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- দীপ জ্বেলে যাই, পৃথিবী আমারে চায়, চিড়িয়াখানা, মায়ামৃগ, ধন্যি মেয়ে, কাল তুমি আলেয়া, ওগো বধূ সুন্দরী, নায়িকা সংবাদ, রাজকন্যা, দেবদাস, গলি থেকে রাজপথ ইত্যাদি। তার অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২১১।

সঙ্গীতপ্রেমী উত্তম কুমার

সঙ্গীতের প্রতিও ছিল তার অসীম ভালোবাসা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে ও শ্যামল মিত্রের গানেই সবচেয়ে বেশি ঠোঁট মিলিয়েছেন উত্তম। গান রেকর্ডিংয়ের সময় শিল্পীর পাশে বসে তার অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন তিনি। উত্তম ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবির সব গানের সুরারোপ করেন। ছবিটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়।

ব্যক্তিগত জীবন

মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন সবার বড়। ছোট ভাই তরুণ কুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন। তারা একসঙ্গে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান। গৌরব চট্টোপাধ্যায় উত্তম কুমারের একমাত্র নাতি। বর্তমানে টালিগঞ্জের জনপ্রিয় ব্যস্ত অভিনেতা। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার তার পরিবার ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি সে সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বসবাস করেন।

চলে গেলেন তিনি

ওগো বধূ সুন্দরী ছবির শুটিং চলাকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এই মহানায়ক। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

উত্তম কুমারের কয়েকটি উক্তি

* আমি নিজের মতো অভিনয় করতে পছন্দ করি, আমি যেভাবে কথা বলি, যেভাবে রেগে যাই- একেবারে স্বভাবসুলভ ও স্বতঃস্ফূর্ত। তবে মাথায় রাখি অভিনীত চরিত্রটির বৈশিষ্ট্য।

* প্রশংসা করলে আমি কাঁচুমাচু হয়ে যাই। কারণ আমি ভাবি, এ প্রশংসা টিকে থাকবে তো? আর তাই প্রশংসাবাক্য শুনলে আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমি ওটা চাই না, কেবলি কাজ আর কাজ।

* কাজকে আমি কখনও ভয় করি না। বরং আমি কাজ থেকে আনন্দ আহরণ করি।

* চলচ্চিত্র আমার নিজস্ব জগৎ, আমার ব্যক্তিগত বলে কিছু ছিল না। যেন আমার প্রতিটি মুহূর্ত বিক্রি হয়ে গেছে।

* আমার কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে যদি কখনও কোনো মৃত্যু সংবাদ আসে, আমি কিছুটা থমকে যাই। আবার আমি আমাকে বোঝাই- মৃত্যুই তো একমাত্র সত্য।