টাকার অভাবে ‘রাজার হালে’ অফিসে!

করোনার ধকল সামলাতে না পেরে আওরঙ্গবাদ শহরে সবজি সরবরাহ করতেন স্বল্প আয়ের শেখ ইউসুফ (৪৯)। এখন তিনি কালো রঙের একটি সুদর্শন ঘোড়ায় চড়ে ‘রাজার হালে’ অফিস করেন নিয়মিত। রাস্তার পাশে থাকা পথচারীরা হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায় ‘ঘোড়াওয়ালা’ ইউসুফকে। যেন তিনি ভারতের মহারাষ্ট্রের এক অঘোষিত রাজা।

২০২০ সালের মার্চ মাসে ভারতে লকডাউন ঘোষণার পরপরই অভাবে পড়েছিলেন চার সন্তানের বাবা শেখ ইউসুফ। শহরের একটি ফার্মেসি কলেজের ল্যাব সহকারীর চাকরি করতেন তিনি। বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ঋণে জর্জরিত হতে থাকেন। তার সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। অনিশ্চয়তা দেখা দেয় ভবিষ্যৎ নিয়েও।

কিন্তু লকডাউনে জরুরি পরিষেবাগুলো চালু থাকায় বেঁচে থাকার এক ভিন্ন পথ খুঁজে পান ইউসুফ। ঠিক করলেন, সবজি পরিবহণের ব্যবসায় নামবেন তিনি। যে কথা, সেই কাজ। কোনোমতে রাস্তায় চলে তার একটি এমন ভাঙাচোরা মরিচা ধরা বাইক ছিল। সেটিতে করে যাদববাড়ি বাজার থেকে সবজি কিনে বাইকে করে পৌঁছে দিতেন আওরঙ্গবাদে।

বন্ধুর পুঁজি থাকায় এ থেকে যা পান তা দিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন ইউসুফ। কয়েক মাস পরই ওয়াইবি চ্যাভান কলেজ অব ফার্মেসি থেকে চাকরিতে ডাক পেলেন পুরোনো পদে। এখন হলো নতুন সমস্যা। মরিচা পড়া পুরোনো বাইকে করে যাতায়াত করা তার জন্য ব্যয়সাপেক্ষ। কারণ, তত দিনে চার পাশের পৃথিবী অনেক বদলে গিয়েছিল, নিজের সঞ্চয় ফুরোনোর পাশাপাশি বেড়ে গিয়েছিল জ্বালানি তেলের দামও। ‘লক্কর-ঝক্কর’ মার্কা বাইকটি ঠিক করবেন সে টাকাও তার কাছে নেই। ইউসুফ বললেন, ‘আমি দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম, কিভাবে ওই এক ঘণ্টার রাস্তা পার হব।’

হঠাৎ মনে হলো তার এক নিকটাত্মীয়ের কাছে থাকা একটি ঘোড়ার কথা। ‘জিগার’ নামের ঘোড়াটি বিক্রি করতে চান সেই আত্মীয়। ‘যেভাবেই হোক, এটি কিনতে হবে’, ইউসুফ বলছিলেন, ‘এটি ছিল আমার স্মার্ট সিদ্ধান্ত’। মরিচা ধরা বাইকটি বিক্রি করে যা পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই তুলে দিলেন আত্মীয়ের হাতে। বাকি টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করবেন বলেও মৌখিক চুক্তি হলো। কাথিয়াওয়ারি জাতের কালো ঘোড়াটিকে মে মাসেই নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন ইউসুফ। নিজের বাসা থেকে অফিস পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রাস্তা পারাপারে চার বছর বয়সি ঘোড়াটি যথেষ্ট উপযুক্ত ছিল। আর এভাবেই ইউসুফ শহরে বিখ্যাত হলেন ‘ঘোড়াওয়ালা’ নামে। রাস্তায় যানজটের ভেতরে না থেকে ফুটপাথ ঘেঁষে নিরাপদে চালাতেন জিগারকে। রাস্তার পুলিশ তেমন একটা সমস্যা করত না।

তবে, ইউসুফ জানান, ‘কয়েকবার আমাকে থামানো হয়েছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, ‘ঘোড়াটিকে চরাতে নিয়ে যাচ্ছি।’ প্রতিদিন খুব ভোরে উঠে তিনি এবং তার ছোট ছেলে ঘোড়াটিকে প্রস্তুত করেন। অফিসে পৌঁছানোর পর জিগারের জন্য একটি স্টোর রুম বরাদ্দ রেখেছেন ফার্মেসি কলেজের অধ্যক্ষ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিগারকে পানি খাওয়ান ইউসুফ। তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখেন। যাতায়াত খরচের জন্য তিনি মাসিক যে চার হাজার রুপি বাজেট রেখেছিলেন, তা এখন বাড়িয়ে করতে হবে ছয় হাজার টাকা। মাসে জিগারের জন্য অত লাগে না। প্রতিদিন তার খাবার বাবদ ৪০ রুপি খরচ হয় ইউসুফের। তার বাড়ির আশপাশের খামার ও মাঠগুলো জিগারের খাবারের ভালো উৎস।