নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে কৌশলী ইসি

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে আপত্তি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি ও নির্বাচনে কারচুপি হবে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি এমন দাবি করে নির্বাচন বর্জন করেছিল প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বে থাকা বিশ দলীয় জোট। অথচ ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে হেরে গিয়ে সমালোচনা করেও ফলাফল মেনে নিয়েছিল বিএনপি ও তাদের জোট।

সেই সময়ে বিএনপি জোটের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অরাজনৈতিক সরকারের চেয়ে রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা থাকা গণতন্ত্রের জন্য ভাল। প্রসঙ্গত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি থাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির টানাপোড়নের মধ্যে ২০০৬ সালে সেনা সমর্থিত সরকার দেশ পরিচালনা করে।

সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ফখরুদ্দিন আহমেদ। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসে। পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে সরে আসে বর্তমান সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই অবস্থানের সমালোচনা করে আসছে বিএনপি ও তাদের শরিকরা।

ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না গিয়ে বর্জন করে বিএনপি। ফলে সারাদেশে ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকরা। এ নির্বাচনে অনেক আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো।

তারপর থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচনের সময়ে কোন সরকার ক্ষমতায় থাকবে তা নিয়ে রাজপথে আন্দোলন ও সভা-সেমিনার হয়ে আসছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অবস্থানের পক্ষে রয়েছে। অপরদিকে বিএনপি এখনও তা মেনে নেয়নি। দলটির দাবি, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই সরকার যেকোনো নামেই হতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্দলীয় সরকার। যে নামেই হোক তা বিএনপি মেনে নিবে। কিন্তু দলীয় সরকার নয়।

এই সংকটের মধ্য দিয়েই আগামী একাদশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের শেষ দিকে বা ২০১৯ সালের প্রথম দিকেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচন সকল মহলে গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপ রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার(সিইসি) নিয়োগের সময়ে সেই বিতর্ক পুনরায় নতুন গতি পায়।

সরকার সিইসি হিসেবে কে এম নুরুল হুদাকে নিয়োগ দিলে, বিএনপি জোরালো প্রতিবাদ না করলেও সমালোচনা করে। পরে মেনেও নেয়। দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সরকারকে ক্ষমতা ছেড়ে সাধারণ কাতারে নেমে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। সব দলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। এজন্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে।

আগামী নির্বাচনের পূর্বে বর্তমান ইসি নির্বাচনী সংলাপের আয়োজন করে। সেখানে নিবন্ধিত সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা অংশগ্রহণ করেন।

সংলাপে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েন, ইভিএম মেশিনে ভোট নেয়া বাদ ও নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি করা হয়। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। ইভিএম ব্যবহার করতে হবে ও সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই, নির্বাচন কমিশন(ইসি) মনে করলে করতে পারে। এছাড়া বামদলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, জামায়াতের কোনো ব্যক্তি যাতে স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতে না পারে।

সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, আগে নির্বাচন কমিশনকে সকলের আস্থাভাজন হতে হবে। এরই মধ্যে সকল দলকে নির্বাচনে আনতে ও ইসির উপর আস্থা বৃদ্ধি করতে বেশ কিছু ঘোষণা ও পদক্ষেপের কথা বলেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন। সূত্র জানিয়েছে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিষয়গুলো কমন, যাতে কেউ আপত্তি করবে না। এমন কিছু বিষয় নির্ধারণ করেছে ইসি।

সেই বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করেছেন তারা। সিদ্ধান্ত নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে আগে। নির্বাচনের আগে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কোনো কথা বা মন্তব্যও করা থেকে বিরত থাকবেন তারা। এজন্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে দলটির বেশ কিছু দাবিও মেনে নেওয়া হবে।

যার প্রমাণ মিলেছে গত ১৫ নভেম্বরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথায়। সিইসি নুরুল হুদা ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মতো সক্ষমতা তৈরি হয়নি। অর্থ্যৎ একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে না, এটা চূড়ান্ত।

এই ঘোষণা বিএনপিকেই সবচেয়ে বেশি খুশি করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ইভিএম ব্যবহারের মতো প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করাটা একটা বিড়াট চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের এমন অনেক অঞ্চল আছে যেখানে এখনও বিদ্যুৎ যায়নি। পুরো দেশের লাখ খানেক ভোটকেন্দ্রের জন্য এতো ইভিএম পাওয়াও মুশকিল। তা আনা, ব্যবহার, পরিবহন ও সংরক্ষণ করা দুঃসাধ্যও বটে। সেই অবস্থানে এখনো যেতে পারেনি বাংলাদেশ।

এই বাস্তবতা থেকে ইভিএম ব্যবহার করা থেকে পিছিয়ে আসছে নির্বাচন কমিশন। বিষয়টি আওয়ামী লীগও বুঝবে বলে মনে করে বর্তমান ইসি। কারণ দলটি এখন সরকারে রয়েছে। বিষয়টি তাদের জন্য বুঝা আরও সহজ। ফলে এক ইস্যুতে দুই রাজনৈতিক দলকে এক জায়গায় আনতে পেরেছে বতর্মান ইসি। আর সেনাবহিনী মোতায়েনের বিষয়ে ইসি এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিষয়টি সময় হলেই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে ইসি।

এটি একটি কৌশলও হতে পারে ইসির। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইভিএম ব্যবহার ইস্যুতে স্পর্শকাতর ও গুরত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। তার প্রতিক্রিয়াও দেখবে সংস্থাটি। হুট করেই সব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে পক্ষ-পাতিত্বের অভিযোগ আসতে পারে। নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হতে পারে। তাই সেনাবাহিনীর বিষয়টি সময়ের উপর ছেড়ে দেয়াটাই উপযুক্ত বলে মনে করছেন তারা।

বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্যও সুখবর বটে। অন্তত একটি বিষয়ে রাজনৈতিক সুরাহা হয়েছে। যা নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে(ইসি) বিতর্কিত করবে না। বিএনপির কাছে ইসির গ্রহণযোগ্যতাও বৃদ্ধি পাবে। ফলে বর্তমান ইসি বিতর্কিত হয় এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতেও নেবেনা বলেই সব মহলে বিশ্বাসের দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এভাবেই দুই দলের মিলগুলো খুঁজে বের করে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশনি(ইসি)।

আগামীতেও বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে তা প্রকাশ পাবে, রাজনৈতিক সহিংসতা কমবে ও সব দল নির্বাচনে অংশ নিবে বলেই মনে করছেন সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক বোদ্ধারা। এতেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরবে বাংলাদেশে ও একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার পাবে বাংলাদেশ।