ফ্রান্সকে পাল্টাতে নয়া কৌশল হাতে ম্যাক্রোঁ

ইংরেজিতে একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায়- যদি নেতার জন্ম হয়, তাহলে তিনিই মাঠ তৈরি করবেন। আর যদি মাঠ তৈরি থাকে, তাহলে যেকোনো মুহূর্তে আবির্ভাব ঘটবে নেতার। এটাকে প্রকৃতির নিয়মও বলা হয়।

ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বেলাতে প্রবাদের দ্বিতীয় অংশটুকু হুবহু মিলে যায়। বলা যায় তার জন্য মাঠ তৈরি করে দিয়েছে ফ্রান্স। সময়ের প্রয়োজনে তিনি পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ।

নির্বাচনের প্রথমেই শক্তিশালী দুই প্রার্থী অযোগ্য ঘোষণা হওয়ায় ম্যাক্রোঁর জন্য জেতার পথ খুলে যায়। অপরদিকে ফ্রান্সে এমন একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রয়োজন পড়েছিল, যিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন। দেশটির জনগণকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিবেন; তবে নতুন কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বেন না।

কট্টরপন্থী মারিয়া লো পেন বা কট্টর বামপন্থী কেউ নির্বাচিত হলে দেশটি নতুন সংকটের মধ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন ফরাসিরা। এই সময়ে বাম ও ডানের মধ্যবর্তী স্থানে কিছুটা উদারপন্থী হওয়ার ঘোষণা দেন ম্যাক্রোঁ। এতেই নবীন ও প্রবীণ ভোটারদের মনজয় করতে সক্ষম হন।

ম্যাক্রোঁর বিপরীতে থাকা প্রার্থী কট্টর ডানপন্থি হওয়ায় তা নিয়ে খোদ শঙ্কিত ছিল ইউরোপিয় ইউনিয়ন পর্যন্ত। এ জোটটি চেয়েছিল উদারপন্থী ম্যাক্রোঁর জয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে ব্রিটেন। এর পরেই ফ্রান্সও এ জোট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বলে আলোচনা শুরু হয়েছিল। এতে দেশটিতে নতুন করে রাজনৈতিক সংকট হতে পারে।

জনগণ চেয়েছিল কট্টরপন্থী ডান ও বামের বাইরে কিছু। কারণ এই দুই দল থেকে প্রেসিডেন্ট হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দুরত্ব বাড়বে। ফলে তার প্রভাব পড়ে দেশটির জাতীয় নির্বাচনে। গেল ৭ মে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে মাক্রোঁ পান ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং তার প্রতিপক্ষ লো পেন পান ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট।

ম্যাক্রোঁ আগে কখনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেননি। এক বছর আগে তিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ সরকারের সদস্য ছিলেন। ওলাঁদ সরকারে যোগ দেয়ার আগে ম্যাক্রোঁ ফরাসিদের মাঝে খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। ৩৯ বছর বয়সী ম্যাক্রোঁ নেপোলিয়নের পরে সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট।

গঠন করেছিলেন নতুন দল
স্পেনে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বামপন্থী ‘পোডেমো’ অর্থাৎ ‘আমরা পারি’। একইসঙ্গে ইতালিতে বিকল্প রাজনৈতিক দল ফাইভ স্টার মুভমেন্ট জনপ্রিয় হয়। ম্যাক্রোঁ জানতেন স্পেন এবং ইতালির মতো কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি ফ্রান্সে গড়ে উঠেনি। সেজন্য ২০১৬ সালে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ে তোলেন এবং একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওঁলাদ সরকারের মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করেন।

ম্যাখোঁর নতুন দলের নাম ফরাসি ভাষায় রাখা হয় অঁ মার্শ (অন দ্যা মুভ)। যেখানে মুক্তবাণিজ্য, অভিবাসন ও যৌথ সার্বভৌমত্বের জন্য দুয়ার খুলে দেয়ার কথা বলা হয়। অপরদিকে লো পেনের জাতীয়তাবাদী ন্যাশনাল ফ্রন্ট শক্তিশালী সীমান্ত এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

অত্যাধিক জাতীয়তা বোধের কারণে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ে ফরাসিরা। বিশ্বায়ন বিরোধিতা করায় লো-পেনের এ দলকেও প্রত্যাখান করেন অধিকাংশ ফরাসিরা। নির্বাচনের আগে প্রায় ২৫ হাজার ভোটারের মতামত সংগ্রহ করেন ম্যাক্রোঁ। তিনি জানতে চান নাগরকিদের মনের কথা। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেন ম্যাক্রোঁ। ঘোষণা দেন, ফ্রান্সকে একতাবদ্ধ করার। ডান ও বামদের মাঝে সেতু বন্ধন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কোনো একক আদর্শের শক্তির কাছে যেন দেশ জিম্মি না হয়। নতুন এক রাজনৈতিক মতবাদের জন্ম দেন তিনি। ম্যাক্রোঁর এই চিন্তাকে ফরাসিরা সাদরে গ্রহণ করে।

২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বারাক ওবামা যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সে বিষয়টিও অনুসরণ করেছিলেন ম্যাক্রোঁ। তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন ফ্রান্সের সরকারি ব্যয় কমানোর জন্যও বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ফ্রান্সের জনগণ যে নতুন কিছু পেতে চায় সেদিকে মনোযোগ দিয়েছেন ম্যাক্রোঁ।

ফ্রান্স জুড়ে যে হতাশা তৈরি হয়েছিল; দেশটিতে ইতিবাচক বার্তা নিয়ে এসেছেন ম্যাক্রোঁ। তিনি তরুণ এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর। সব কিছু মিলিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার করতে পেরেছিলেন। আর এসব কারণেই তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করেছে ফ্রান্স।