বিএনপির উপজেলা নির্বাচনে অংশ: লাভ-ক্ষতি নিয়ে কৌশলী

জাতীয় নির্বাচনের পর এবার উপজেলা নির্বাচনের দিকে হাঁটছে নির্বাচন কমিশন। এদিকে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে কোনো ভোটে অংশ না নেওয়ার অবস্থানেই এখনো অটল আছে বিএনপি। তবে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ইস্যুতে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আরও সময় নিতে চায় দলটির হাইকমান্ড।

বিএনপির অবস্থান হচ্ছে আগে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করুক, তার পর দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি।

এদিকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী দলটির তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা। ইতোমধ্যে অনেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। সে বিবেচনায় ‘কৌশলী’ হতে পারে দলটি। সে ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকে না যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। অন্যদিকে স্বতন্ত্রভাবে কেউ অংশ নিলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিয়ে ‘নমনীয়তা’ দেখাতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলীয় ফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কাউকে বাধা না দেওয়া কিংবা নিরুৎসাহিত না করা- কোনো আলোচনাই হয়নি। তিনি আরও বলেন, এই সরকারের আমলে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনও নিরাপদ নয়। তাদের ভোটের চরিত্র এক। তাই স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচন-এ নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নেই।

আগামী মে মাসে চার ধাপে ৪ শতাধিক উপজেলা পরিষদের নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ আগামী ৪ মে, দ্বিতীয় ধাপে ১১ মে, তৃতীয় ধাপে ১৮ মে এবং চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ২৫ মে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা এবার স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দেবে না। ফলে এ নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীক এবং আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী থাকছে না।

এদিকে বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা জানিয়েছেন, তারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেয়ার প্রশ্নে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক লাভ-ক্ষতি নিয়ে ভাবছেন। বিশেষ করে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সরকার এর থেকে কী ধরনের রাজনৈতিক সুবিধা পাবে। আর নির্বাচন না করলে বিএনপির রাজনৈতিকভাবে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে।

বিএনপি নেতারা এও বলছেন, বিএনপি শুধু নির্বাচনমুখী দলই নয়, এ দলের ভিত্তিই হলো জনগণ ও সুষ্ঠু ভোট। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পরপরই উপজেলা পরিষদের নির্বাচন দলকে অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। বিএনপি ঘোষণা দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধীদের কাছ থেকে সরকারের ‘বৈধতা’ পাওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। এতে মনে হতে পারে, বিএনপি সরকারকে মেনে নিয়েছে। এর সুযোগ নেবে সরকার। আর নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ে নেতাদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা আরও সময় নিতে চাচ্ছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে শতাধিক উপজেলায় বিএনপির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরেও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে প্রথম দিকে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপের’ অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর ধারাবাহিকতায় সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বর্জন করে। এরপর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় কুমিল্লায় মনিরুল হক সাক্কু, নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকারসহ অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনেও কিছু নেতা নির্বাচন করেন। তাদেরও সবাইকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। এখন নির্বাচন পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে মনে করেন দলের মাঠপর্যায়ের নেতা বা সাবেক জনপ্রতিনিধিদের অনেকে। তবে এবারও আসন্ন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু এবং কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি (বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার। এদিকে জানা গেছে, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, জামালপুরসহ অনেক জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কিছু নেতা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ইতোমধ্যে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আবার অনেকে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।

তবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বিএনপিতে দুটি অংশ রয়েছে। একটি অংশের নেতারা মনে করেন, তারা বর্তমান সরকারকে অবৈধ বলছেন, নির্বাচন কমিশনের কাছে সুষ্ঠু ভোট আশা করেন না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করেছেন। এমন অবস্থায় কোনো নির্বাচনেই যাওয়ার সুযোগ নেই। ভোটে অংশ নিলে বিএনপির ওপর সাধারণ মানুষের যে আস্থা আছে, তা আর থাকবে না। সরকারের পদত্যাগসহ ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তারা আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলন থেকেও সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীদের দৃষ্টি ভিন্নদিকে চলে যাবে। যা হবে দলের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আরেকটি অংশ বলছে, আন্দোলনে ব্যর্থতা ও সংসদ নির্বাচনের পর মাঠের নেতা-কর্মীরা এখনো হতাশায়। নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ এখন মামলা, বিচার, সাজার রায় নিয়ে আদালতে যাওয়ার মধ্যে রয়েছেন। আরেকটি অংশ এখনো কারাগারে। আন্দোলনের কর্মসূচিও এখন সেভাবে নেই। এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার কৌশল নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে একটি বড় ক্ষেত্র হতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সভা-সমাবেশসহ একধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা থাকে। যেহেতু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘নৌকা’ প্রতীক এবং একক প্রাথী দিচ্ছে না। বিএনপিও ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে অংশ না নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নেতাদের ভোট করার সুযোগের কৌশল নেওয়া উচিত।