ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেলের পুষ্টিগুণ নিশ্চিতকরণে স্মার্ট ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম বাস্তবায়নের নেতৃত্বে শিল্প মন্ত্রণালয়

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের জন্য খাদ্যের পুষ্টিমান সমৃদ্ধকরণ, স্বাস্থ্যের উন্নতি, দৈহিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এবং জনস্বাস্থ্যকে সুরক্ষা দিতে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় ফোর্টিফাইড ফুড উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (GAIN) এর সহযোগিতায় “ডিজিটাইজেশন অফ ফরটিফিকেশন অফ এডিবল ওয়েল ফর ইমপ্রুভড মনিটরিং, কোয়ালিটি কনট্রোল অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং” শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় আজ ১২ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকায় “ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেলের গুণগত মান নিশ্চিতকরণে ডিজিটাল মনিটরিং ও বোতলজাতকরণে সচেতনতা বৃদ্ধি” শীর্ষক একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন প্রকল্প পরিচালক এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুঃ আনোয়ারুল আলম।

কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ ফয়েজুল আমীন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) এর মহাপরিচালক এ.এইচ.এম শফিকুজ্জামান, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এর মহাপরিচালক মোঃ আবদুস সাত্তার, এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (GAIN) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. রুদাবা খন্দকার। এছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি মহলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, রিফাইনারি, বাংলাদেশ পাইকারি ও খুচরা তেল ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধিবৃন্দ এই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন। কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. আশেক মাহফুজ, পোর্টফোলিও লিড, লার্জ স্কেল ফুড ফরটিফিকেশন এবং ভ্যালু চেইন, গেইন বাংলাদেশ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা বলেন, জনস্বাস্থ্য সব সময়ই একটি অগ্রগণ্য বিষয়। তাই জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণে ডিজিটাল স্মার্ট ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম অন্তর্ভূক্ত করার পদক্ষেপকে তিনি স্বাগত জানান। এই প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণকে তিনি উৎসাহিত করে বলেন, যে কোন নতুন কিছু প্রতিষ্ঠিত করতে ধাপে ধাপে কাজ করতে হয় এবং এটি সময় সাপেক্ষ।

সকলে সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিবেচনায় সকলকে তিনি এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে দ্রুততম সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই ধারাবাহিকতাকে অব্যহত রাখতে এবং ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে দায়িত্বশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে ভূমিকা পালনে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) এর মহাপরিচালক এ.এইচ.এম শফিকুজ্জামান ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্র্রতিষ্ঠান এবং রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোর খোলা তেল বাজারজাতকরণ বন্ধ করার বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়কে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান। পাশাপাশি তিনি ডিজিটাল সিস্টেম সম্পর্কে উল্লেখ করেন, যা ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে তাদের প্রোডাকশন ভ্যালুচেইন এর ফর্টিফিকেশন সংক্রান্ত ডাটা ট্রেস করতে এবং বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করবে। গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (GAIN) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. রুদাবা খন্দকার তার বক্তব্যে ডিজিটালাইজেশনের এই উদ্যোগের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার আহ্বান জানান।

কর্মশালায় বক্তারা উল্লেখ করেন যে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের পথযাত্রায় সরকার নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটা সত্যিই আশাব্যঞ্জক ও প্রশংসনীয় যে বাংলাদেশের “ডিজিটাল বাংলাদেশ” রূপকল্প রয়েছে। খাদ্যে পুষ্টিমান সমৃদ্ধকরণ এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে খাদ্য লবণ ও ভোজ্যতেলের ফরটিফিকেশন বাধ্যতামূলক করাও সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন উন্নত মনিটরিং সিস্টেমসহ ডিজিটালাইজড ফর্টিফিকেশন ব্যবস্থাও সরকারের অন্যতম সাফল্য।ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্যের ধারা অব্যহত রাখতে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম জনশক্তি অন্যতম নির্ণায়ক। তাই জনস্বাস্থ্যকে সবার উপরে গুরুত্ব দিয়ে খাদ্য লবণ ও ভোজ্যতেলের পুষ্টিমান সমৃদ্ধকরণ নিশ্চিত করতে ডিজিটালাইজড ফর্টিফিকেশন ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য, এ প্রকল্পের সহায়তায় বর্তমান প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে সামগ্রিক ও সমন্বিত ভাবে Fortified food বা খাদ্য এর গুণগত মান নিশ্চিতকরনের জন্য একটি ক্রস-সেক্টর ডেটা সিস্টেম” তৈরির কাজ চলছে।

রিফাইনারী পর্যায়ে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ভোজ্যতেলের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, উন্নত পর্যবেক্ষণ, এবং ফুড ফর্টিফিকেশন ভ্যালুচেইন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ফুড ফর্টিফিকেশন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট রিফাইনারী, রেগুলেটরী প্রতিষ্ঠান, এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি ডিজিটাল ফোর্টফিকেশন কোয়ালিটি ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম চালু করা।

২০২১ সালে প্রকল্পটির সূচনাকালে এটি “ডিজিটাল বাংলাদেশ” এর রূপকল্পের সাথে সংযুক্ত ছিল এবং এখন “স্মার্ট বাংলাদেশ” ২০৪১ রূপকল্পের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন এর সহায়তায় শিল্প মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে যাতে সুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি বজায় রাখার জন্যে সঠিক মাত্রায় প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ এর সাথে ভোজ্যতেল ফরটিফিকেশন নিশ্চিত হয়। ফোর্টিফিকেশনের মান ও ফোর্টিফাইড খাবার ভোক্তাদের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছায় কিনা তা পর্যাবেক্ষন করতে এই প্রকল্প কাস্টামাইজড ডিজিটাল সিস্টেম চালু করবে।

বাংলাদেশে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খাদ্য লবণের ফোর্টিফিকাশন বাধ্যতামূলক এবং প্রায় ১০ বছর ধরে ভোজ্যতেলের ফোর্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক, তবে এই খাবারগুলোর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট উপাদান বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের নির্ধারিত মান পূরণ করে কীনা তা নিশ্চিত করা কঠিন ছিল। মার্কেট পর্যায়ে খাবার তৎক্ষণাৎ পরীক্ষা করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে খাবার অপর্যাপ্তভাবে ফোর্টিফাই করা বা কোন কোন ক্ষেত্রে ফোর্টিফাই করাই হয় নি।

এর ফলে বাংলাদেশের উচ্চ মাত্রার মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি মোকাবেলায় ফুড ফোর্টিফিকেশন আশানুরুপ ভাবে কার্যকর হতে পারছে না। যার মধ্যে ভিটামিন এ এবং আয়োডিনের ঘাটতিও রয়েছে। দেশের গুরুতর স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে, বাংলাদেশের ২০১৯-২০ ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ এর যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে।

অপর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ এর কারণে শরীরের ইমিউন সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করে না, শ্বাসযন্ত্র এবং ডায়রিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে, শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থামিয়ে দেয় এবং গুরুতর অসুস্থতা থেকে বাঁচার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। প্রজননক্ষম নারীদের এর মধ্যেও ভিটামিন ‘এ’ -এর অভাব পাওয়া গেছে। ভিটামিন ‘এ: এর অভাব গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা ও মাতৃমৃত্যুর জন্য দায়ী। ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের জরিপে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে এবং প্রজননক্ষম মহিলাদের এর মধ্যে আয়োডিনেরও ঘাটতি পাওয়া গেছে। আয়োডিনের অভাবে গলগন্ড রোগ সহ থাইরয়েডের বিভিন্ন রকম সমস্যা হতে পারে। আয়োডিনের অভাব শিশুদের মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার একটি প্রধান প্রতিরোধযোগ্য কারণ।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি চরম ক্লান্তি সৃষ্টি করে, কার্যক্ষমতা হ্রাস করে এবং হতাশা এবং সমাজের সাথে বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়। দেশের ফোর্টিফাইড ফুড উৎপাদনকারীদের জন্য, ডিজিটাল বিপ্লব ফোর্টিফিকেশন সমস্যা মোকাবেলায় নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং সেই সাথে তাদের ব্যবসার দক্ষতা এবং মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। পাইলট প্রজেক্টে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত তেল উৎপাদনকারীদেরকে ডিজিটাল বিশেষজ্ঞদের একটি দল কো-ডিজাইন এবং নতুন ডিজিটাল মান নিশ্চিতকরণ/মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইনস্টল করতে সহায়তা করবে যা উৎপাদনকারীদের সঠিক মান নিশ্চিতকরন এবং ইন্সাইট প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক ভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে সাহায্য করবে।