৩০ মিনিটের সফরে নিরাপত্তার চাদরে

মোদির আগমনে দৃষ্টিতে সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী মন্দির

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বশেষ উপজেলা শ্যামনগর। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ এই উপজেলাটি সাতক্ষীরা জেলার অধীন। সীমান্তের ওপারেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
সেই শ্যামনগরের প্রত্যন্ত ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত যশোরেশ্বরী কালী মন্দির একটি স্বল্প পরিচিত মন্দির। কালক্রমে ওই মন্দিরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-গুরুত্ব কিছু দিন আগ পর্যন্তও ছিলো অনেকের অজানা-অচেনা। তবে অতিসম্প্রতি ওই মন্দিরটি হঠাৎ করেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। কারণ আগামি ২৭ মার্চ সেখানে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই অজানা-অচেনা মন্দির এখন সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘মুজিব বর্ষ’ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের সূবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের জন্য আগামি ২৬ মার্চ বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।

নরেন্দ্র মোদির ভ্রমণ তালিকায় হিন্দু ধর্মালম্বীদের পবিত্র স্থান ঈশ্বরীপুরের যশোরেশ্বরী কালী মন্দির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই পুরো ফোঁকাস যেন সেই মন্দিরের ওপরই।

জানা গেছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত যশোরেশ্বরী কালী মন্দির একটি অতি প্রাচীন পবিত্র স্থান।

ধারণা করা হয়, দ্বাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আনারি নামে একজন ব্রাহ্মণ এই মন্দির নির্মিত করেছিলেন।
তিনি যশোরেশ্বরী পীঠের জন্য ১০০ দরজার মন্দির তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাজা লক্ষ্মণ সেন এটি সংস্কার করেন এবং সর্বশেষ রাজা প্রতাপাদিত্য ষোড়শ শতাব্দীতে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেন।

সেখানে হিন্দু ধর্মের শক্তির দেবী সতীর দেহাবশেষ পড়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়।

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, এই মন্দিরটি ৫১টি শক্তি পীঠের মধ্যে একটি। এই পীঠগুলো ভারত ও ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে ছয়টি পীঠ।

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, ৫১টি পীঠের মধ্যে ঈশ্বরীপুরের মন্দিরটি হলো সেই স্থানে যেখানে দেবী সতীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা এসে পড়েছিল।

শক্তিপীঠের পেছনের গল্পটি হলো- দেবী সতীর আত্মহননের পর, তার স্বামী শিব তার দেহাবশেষ নিয়ে ধ্বংস নৃত্য করেন।
বিষ্ণু এই ধ্বংস থামানোর চেষ্টাকালে সতীর মৃতদেহে সুদর্শন চক্র ব্যবহার করেন। ফলে তার দেহ ছিঁন্ন হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পড়েছিল।

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, যেসব জায়গায় তার দেহের অংশ পড়েছিল সেগুলোর প্রতিটিকে বলা হয় শক্তি পীঠ।

এদিকে, নরেন্দ্র মোদির দুই দিনের সফর পরিকল্পনা অনুসারে, ২৬ মার্চ তিনি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন এবং জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভাষণ দেবেন।
সেদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

পরের দিন ২৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধু স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবেন মোদি। সেই সঙ্গে তিনি সাতক্ষীরা ও ওড়াকান্দিতে দু’টি মন্দির পরিদর্শন করবেন।

সফরের শেষ দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার মোদি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর গ্রামে গিয়ে এই মন্দিরে পূজা দেবেন।

জানা গেছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যান সাধারণত সেখানেই কোনো মন্দিরে গিয়ে পূজা করেন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে পূজা করেছিলেন মোদি।

এদিকে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের খবরে পুরো সাতক্ষীরা এলাকাটিই উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ।

যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরের সেবায়েত (তত্ত্বাবধায়ক) জ্যোতি চট্টোপাধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে জানান, তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের মন্দিরে আসবেন জেনে আমরা অভিভূত। মোদিজি এখানে শুধু পূজা দিতে আসছেন।’

নরেন্দ্র মোদির ৩০ মিনিটের সফরে সাতক্ষীরা নিরাপত্তার চাদরে

আগামি ২৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হেলিকপ্টারযোগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুরের যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে পূজা দিতে আসছেন। আসা-যাওয়া, অবস্থান মিলিয়ে ৩০ মিনিটের সফর তাঁর।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে নিরাপত্তার চাদরে গোটা সাতক্ষীরা। শুধু শ্যামনগরের আগমনস্থল নয়, গত কয়েক দিন ধরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে জেলা ব্যাপী ও পার্শ্ববর্তী এলাকাও।

তার আগমনক উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের টহল ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি প্রতিদিন র্যাব, এসবি সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগমনস্থল পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ করছেন। সফর প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নে নানান উদ্যোগ নিয়েছেন, মিটিং করছেন।
ইতোমধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন।

এদিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের উৎসবের আমেজ।
তার সফরটি খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও আয়োজনে কোনও ঘাটতি রাখছেন না সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে তারা সেখানে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।

হেলিপ্যাড থেকে যশোরেশ্বরী কালী মন্দির পর্যন্ত সাজানো হয়েছে নান্দনিকভাবে।

সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে ইতোমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। ৪টি হেলিপ্যাড নির্মাণ করা হয়েছে। হেলিপ্যাড থেকে যশোরেশ্বরী কালী মন্দির পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে নান্দনিকভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরসহ সংস্কার করা হয়েছে সংলগ্ন সড়কও।’

তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশ্রামের বিষয়টিও মাথায় রেখে স্থানীয় ভূমি অফিসকেও সাজানো হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে। সফরসূচি অনুযায়ী নরেন্দ্র মোদি আগামি ২৭ মার্চ সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে শ্যামনগর এ. সোবাহান মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে নবনির্মিত হ্যালিপ্যাডে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে অবতরণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এরপর তিনি সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে যশোরেশ্বরী দেবী মন্দিরে পূজা দেওয়ার জন্য প্রবেশ করবেন। সেখানে তিনি মাত্র ২০ মিনিট থাকার পর ১০টা ১০ মিনিটে মন্দির ত্যাগ করবেন। পরে তিনি ১০টা ১৫ মিনিটে হেলিকপ্টারযোগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় রওনা হবেন। সেখানে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ পরিদর্শন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।’

তিনি আরও জানান, ‘নরেন্দ্র মোদির আগমনকে ঘিরে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয়েছে গোটা সাতক্ষীরা। নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছেন এসএসএফ। তাদের সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা।’

তিনি জেলাব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ রয়েছে বলে জানান।

কেন মোদি এই মন্দিরে:

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নরেন্দ্র মোদির এই মন্দির পরিদর্শনের দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। একটি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন এবং অপরটি প্রার্থনা। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দিতে ‘মতুয়া’ সম্প্রদায়ের পবিত্র মন্দিরে যাবেন পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত মতুয়াদের মন জয় করতে।
কিন্তু, যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে কেন যাচ্ছেন তিনি? কারণ হতে পারে, এটি ভক্তদের কাছে ‘শক্তি দেবতা’র মন্দির।

তাছাড়া, যশোরেশ্বরী কালী মন্দির সাতক্ষীরার মে উপজেলায় অবস্থিত সেই শ্যামনগর সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। আসছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে জিততে কোমর বেঁধে নেমেছে রাষ্ট্রীয় শাসকদল নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। ইতোমধ্যে অতিঅল্প সময়ের ব্যবধানে দিল্লি থেকে উড়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকবার কয়েক স্থানে জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন মোদি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূলকে হটিয়ে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ প্রতিষ্ঠায় তথা দিল্লি-কলকাতা সরকার সংযুক্ত করতে আদা-জল খেয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে মোদির বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মন জয় করতে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া সাতক্ষীরার শ্যামনগরের যশোরেশ্বরী কালী মন্দির তুরুপের তাসও হতে পারে। রথ দেখা হলো, কলা বেচাও হলো; পূজা অর্চনা করাও হলো পাশের পশ্চিমবঙ্গের সনাতন ধর্মাবলম্বী ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টাও হলো। এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।