রোহিঙ্গা সংকট : ক্যাম্পে অনাথ রোহিঙ্গা শিশু দুই হাজার

মিয়ানমারের সেনাদের বর্বরতায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অনাথ শিশুদের সংখ্যা এরই মধ্যে দুই হাজারে পৌঁছেছে। ২ থেকে ১২ বছর বয়সী এসব শিশুর বেশিরভাগ বাবা-মা-ই মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে আবার দীর্ঘ দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে পিতামাতাকে হারিয়ে ফেলেছেন। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের নিয়ে কাজ করা ইউনিসেফ বলছে, সবশেষ বাংলাদেশে ঢুকে পড়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে শিশুদের সংখ্যা তিন লাখ। শরণার্থী শিবিরগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাবা-মাহারা শিশুর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। কিছু শিশুকে এরই মধ্যে তাদের বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থ্যাংখালী, পালংখালী, টেকনাফের নয়াপাড়া ও লেদা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া যায়।

উখিয়ায় কথা হয় ইউনিসেফের কমিউনিকেশন ম্যানেজার শাকিল ফায়জুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনে নিহত বাবা-মাহারা শিশুদের তালিকা করা হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে আমাদের ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার শিশুকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩ লাখ শিশুর মধ্য থেকে অনাথ শিশুদের বাছাই করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, এই সব শিশুর জন্য আমাদের কোনো শিশু সুরক্ষা কেন্দ্র নেই (সেফহোম)। শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে তাদের দেখভাল করছি আর হারিয়ে যাওয়া শিশুদের বাবা-মা ও অভিভাবকের খোঁজ করছি। তবে আশার কথা হচ্ছে, এরই মধ্যে অনেক শিশুকে তাদের বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।

উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের রাস্তার ধারে দুটি শিশুকে দেখে এগিয়ে যাই। তাদের এবং পাশের লোকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, রুবিনা ও মমো দুই বোন। মিয়ানমারের সেনারা অনেকের সঙ্গে তাদের বাবা-মাকেও হত্যা করেছে। পরে স্বজনকে সঙ্গে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে তারা। সেই থেকে অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের জীবন কাটছে। রুবিনা ও মমোর পাশেই খাবার খাচ্ছিল আরেক অভিভাবকহারা শিশু হাকিম। বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করা হলে হাকিম জানায়, তার বাবা-মা নেই। সেনা নির্যাতনে তারা প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে যখন যে যা দেয় তাই তারা খাচ্ছে। টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া অনেক শিশু তাদের স্বজনদের সঙ্গে আছে। কথা হয় টেকনাফের সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা শিশু আরাফাতের চাচা আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি জানান, আরাফাতের বাবা-মা বার্মায় মারা গেছে। পরে আমরা আরাফাতকে আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশে নিয়ে আসি। নয়াপাড়া সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পের ডাক্তার বিপুল ইসলাম বলেন, গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে এই পর্যন্ত ৩৪১ জনকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। বাবা-মাহারা শিশু রয়েছে। বেশিরভাগ শিশুই বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে। মোটা পলিথিনে মোড়ানো টংঘরে রোহিঙ্গাদের দুর্দশার যেন শেষ নেই। জ্বর, সর্দি, কাশি, অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রোগে আক্রান্ত অনেকেই। বেশিরভাগ শিশুকে দেখা যায় রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘুরে বেড়াতে। ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইনে পুলিশ পোস্ট ও সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরএসএ) হামলার পর থেকে সেখানে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়। অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা সদস্যরা গণহত্যায় মেতে ওঠে। শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে কক্সবাজারে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচ লাখে পৌঁছেছে। আগে থেকেই চার লাখের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল।-যুগান্তর