সামনে লম্বা সারি, পেছনে ‘বেশি দামে’ ট্রেনের টিকেট বিক্রি

ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট মাস্টার, টিটি ও গেটম্যানদের বিরুদ্ধে ট্রেনের টিকেট জালিয়াতি করে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এতে টিকেটের অর্থ রেলওয়ের তহবিলে জমা না হয়ে তা যাচ্ছে কিছু ‘অসাধু’ ব্যক্তির পকেটে।

মঙ্গলবার সুন্দরবন ট্রেনের ভ্রমণের সময় সরেজমিনে টিকেট জালিয়াতির বিষয়টি সামনে উঠে আসে।

স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে ঈদ উপলক্ষে ট্রেনের টিকেট প্রত্যাশীদের সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ সকাল সাড়ে ৭টায় রেল স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে ছিল লম্বা সারি। তাদের অনেকেই এসেছে অগ্রিম টিকেট নিতে, আবার কেউ প্রতিদিনের যাত্রী হিসেবে। রেল স্টেশনের দুটি কাউন্টার থেকে টিকেট দেওয়া হচ্ছিল খুব ধীর গতিতে। কাউন্টার ছাড়তে একজন টিকেট প্রতাশীর ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগছিল।

আরো দেখা যায়, মঙ্গলবার সকালে খুলনা রেল স্টেশনের কাউন্টারের সামনে যখন টিকেট প্রত্যাশীদের লম্বা সারি, তখন কাউন্টারের পেছনের দরজা দিয়ে বেশি দামে টিকেট বিক্রি করছিলেন খোদ টিকেট মাস্টার। ঢাকায় যাওয়ার ট্রেনের টিকেট ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী যেকোনো ট্রেন ছাড়ার ৩০ মিনিট আগে ওই ট্রেনের টিকেট বিক্রি করা হয়। সেই হিসেবে খুলনা থেকে ঢাকাগামী সুন্দবন এক্সপ্রেস ছাড়ার সময় ছিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। কিন্তু সকাল ৮টা থেকে সারিতে দাঁড়িয়ে সকাল ৮টা ৩০ মিনিট পযর্ন্ত অপেক্ষা করলেও নিয়মিত যশোর বা কাছের যাত্রীদের টিকেট দেওয়া হয়নি। কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে, ট্রেনে উঠতে, বাইরে টিকেট দেওয়া হবে। বিষয়টি খুলনা স্টেশন মাস্টারকে বলা হলে তিনি যাত্রীদের ট্রেনের ভেতর টিকেট দেওয়ার কথা জানান।

ট্রেনে ভিন্ন চিত্র
সুন্দরবন ট্রেনের যাত্রীরা ট্রেনে উঠলে নিয়ম মাফিক টিটি, চেকারের ছয়-সাতজনের একটি দল এসে বিনা টিকিটের যাত্রীদের থেকে টিকেটের টাকা আদায় করেন। কিন্তু তাদের কাউকেই টিকেট দেওয়া হয়নি। ট্রেনের ৭২১৯ নম্বর বগিতে (এসি চেয়ার কোচ) খুলনা থেকে যশোর আসেন ১৫ থেকে ২০ যাত্রী। ট্রেনে তাদের সবার কাছ থেকে ১৩০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা আদায় করা হয়। তবে কাউকে টিকেট দেওয়া হয়নি। সবাইকে আশ্বাস্ত করা হয়, যশোর স্টেশন গেট পার করে বাইরে বের হওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি খুলনা থেকে যশোরে পৌঁছায় সকাল ৯টা ১০ মিনিটে। এ সময় চেকারদের একজন যশোরের যাত্রীদের নিয়ে স্টেশন থেকে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

এ বিষয়ে যশোর স্টেশন মাস্টার পুম্পল কুমার চক্রবর্তীকে জানালে তিনি স্টেশনের গেটের দায়িত্বে থাকা সাহিদা রহমান ডেকে ডাকেন। সাহিদা রহমান জানান, টিটি আর চেকাররা মাঝে মধ্যে কিছু লোক ছেড়ে দিতে বলেন। আজকে ছেড়ে দেওয়া যাত্রীরা স্টাফদের স্বজন হতে পারেন।

তবে খুলনা, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা রুটের নিয়মিত কয়েকজন যাত্রী জানান, ঈদের সময় ছাড়া অন্য যেকোনো সময় তারা ট্রেনে চেকার ও টিটিদের থেকে কম টাকা দিয়ে ভ্রমণ করে থাকেন। টিটি ও চেকাররাই তাদের স্টেশনের বের হওয়ার গেট পার করে দিয়ে যান।

ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগ, টিকেট কাউন্টারে গিয়ে টিকেট পাওয়া যায় না। তবে বেশি টাকা দিলে ট্রেনের সিট পাওয়া যায়। আর টিকেট কাউন্টারের বিক্রেতারা সব সময় কিছু সিট খালি রেখে দেন। সেখানে টিটি আর চেকাররা পরে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেন। টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন, টিটি, চেকার ও গেট টিকিট চেক করার দায়িত্বপ্রাপ্তরা ওই টাকা ভাগাভাগি করে নেন।

টিটি ও চেকারদের সহায়তায় ট্রেনে চলাচলকারী একজন যাত্রীর থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনার পর যশোর রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার পুম্পল কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘দুভাগ্য আমাদের, ১৫০ টাকাও দুর্নীতি করতে হয়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) খুলনার সমন্বয়কারী অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, দেশে যত দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণা জোরদার হচ্ছে, ততই দুর্নীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে।