সেই বাংলাদেশ, এই বাংলাদেশ

নয়-ছয় করা মানেই সর্বনাশা কারবার। কিন্তু বাংলাদেশের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর কেন যেন এমন এক ছন্দ মেনে চলছে। ২০০২ সালের ঠিক ছয় বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিল বাংলাদেশ। আবার ঠিক নয় বছর পর বাংলাদেশ কোনো সিরিজ খেলতে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। এর মধ্যে অনেক কিছুই হয়েছে ক্রিকেটে। দুটো বিশ্বকাপ, গোটা পাঁচেক বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আর দুটো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির দেখা মিলেছে। বাংলাদেশ নিজেই একটি বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আয়োজন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের আর প্রোটিয়াদের মাঠে খেলা হচ্ছিল না। অন্তত দ্বিপক্ষীয় কোনো সিরিজে।

এ দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই বদলে গেছে। ‘পাওয়ার প্লে’ নিয়ে অনেক ধরনের খেলা খেলেছে আইসিসি। ক্রিকেটের আইনেও এসেছে অনেক রদবদল। এই সিরিজ দিয়ে ফুটবলের লাল কার্ডও চলে আসছে ক্রিকেটে। ব্যাটের সাইজও কমে আসছে এবার। তবে এসব কিছু নয়, সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে বাংলাদেশ দলে। ২০০৮ সালের সেই বাংলাদেশ আর ২০১৭-এর বাংলাদেশের মাঝে যে যোজন যোজন তফাত! ২০০৮ সাল পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশের সাফল্য বলতে ছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের সেই ম্যাচ। আর বর্তমানে বেনুনিতে থাকা এ দলটি শুধু টেস্টের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দল অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ডকে হারায়নি, শ্রীলঙ্কাকেও হারিয়ে এসেছে তাদেরই মাঠে।

দুই স্কোয়াডের মধ্যে তুলনা

  ২০০৮ স্কোয়াড ২০১৭ স্কোয়াড
ব্যাটিং রান ১৯২৪, মোহাম্মদ আশরাফুল ৩৮৪৭, তামিম ইকবাল
সেরা গড় ২৬.৩, সাকিব আল হাসান ৩৯.৬৫, তামিম ইকবাল
সর্বোচ্চ স্কোর ১৫৮*, মোহাম্মদ আশরাফুল ২০৬, তামিম ইকবাল
মোট সেঞ্চুরি ২১
মোট ফিফটি ১৮ ৮১
মোট রান ৪০৮৮ ১৪৩৯৭

২০০৮ সালেও দুই টেস্ট খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৫ জনের সে স্কোয়াডে ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল ও মাশরাফি বিন মুর্তজার মতো খেলোয়াড়। টেস্ট ক্রিকেটে যাঁরা এর আগেই কাটিয়ে দিয়েছেন সাত বছর। তবু পুরো স্কোয়াড মিলে মাত্র ১৩৫টি টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছিল সেবার। অভিজ্ঞতম খেলোয়াড়ের নামটি ছিল আশরাফুল। ৪৪ টেস্ট খেলা আশরাফুলই ছিলেন দলের নেতৃত্বে। দলের সর্বোচ্চ রানও তাঁর, ১৯২৪। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ছিল মাশরাফির! তাঁর ৬৪৭ রানের পরেই ছিলেন মাত্র ৮ ম্যাচ খেলা সাকিব (৩৪২ রান)। রানের গড়ে আবার শীর্ষে ছিলেন ওই সাকিব (২৬.৩)। দুইয়ে ছিলেন মাত্র ৬ টেস্ট খেলা তামিম ইকবাল (২৫.২)। অধিনায়ক আশরাফুলের গড়ের (২৩.৭৫) প্রসঙ্গ না টানতে পারলেই ভালো হতো!

তবে আশরাফুল এগিয়ে ছিলেন অন্যদিক থেকে। বাংলাদেশ দলের যে কেউ সেঞ্চুরি করতে জানেন, সেটা যে ওই স্কোয়াডের আর কারও জানা ছিল না। সবেধন নীলমণি হয়ে চারটি সেঞ্চুরির অভিজ্ঞতা নিয়ে সিরিজ শুরু করেছিলেন আশরাফুল। তবে সিরিজ শেষেও সে সংখ্যা তাঁর বাড়েনি। এ তো গেল সেঞ্চুরির কথাবার্তা। ফিফটির সংখ্যাও ছিল মাত্র ১৮!

আর ২০১৭ স্কোয়াডে শুধু অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ফিফটির সংখ্যাই ১৮। তামিম অবশ্য অধিনায়ককে ছাড়িয়ে এগিয়ে আছেন আরও অনেক বেশি (২৪)। পুরো স্কোয়াড মিলে ফিফটির সংখ্যা ফিফটি ছাড়িয়েছে (৮১)। সাকিব আল হাসান বিশ্রাম না নিলে সেঞ্চুরির সংখ্যাও পেরোত কোয়ার্টার সেঞ্চুরি (২১)। সাকিববিহীন এ স্কোয়াডে পাঁচজন ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি আছে। সবার ওপরে অবশ্যই তামিম (৮টি)। রানেও তা-ই, দুইয়ে থাকা মুশফিকের (৩৪২৩) চেয়ে চার শ রানে এগিয়ে তামিম (৩৮৪৭)। রান গড়ে অবশ্য সবচেয়ে এগিয়ে মুমিনুল হক (৪৬)।

বোলিংয়েও এগিয়ে আছে এবারের বাংলাদেশ। সেবার বোলিংয়ের ভার ছিল মাশরাফি (৬৯ উইকেট) ও শাহাদাতের (৪৩ উইকেট) কাঁধে। মাত্র ১৩ উইকেটের অভিজ্ঞতা নিয়েই স্পিন সামলানোর ভার ছিল সাকিবের কাঁধে। সে দায়িত্ব দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েই সেরেছিলেন সাকিব। দুই ম্যাচে মাত্র দুই ইনিংসে বল করার সুযোগ পেয়েছিলেন। দুই ইনিংসেই পাঁচ উইকেট ছিল তাঁর। এবার সেই সাকিবই নেই। ফলে স্কোয়াডও হারিয়ে ফেলেছে ১৮৮টি টেস্ট উইকেটের অভিজ্ঞতা। অবশ্য সাকিবকে ছাড়াই এ স্কোয়াডে থাকা অন্য বোলারদের উইকেট সংখ্যা (২১৫), মাশরাফি-শাহাদাতদের সে দলের চেয়ে (১৫৫) অনেক বেশি।

দুই স্কোয়াডের মধ্যে তুলনা

  ২০০৮ স্কোয়াড ২০১৭ স্কোয়াড
বোলিং উইকেট ৬৯ , মাশরাফি বিন মুর্তজা ৫৪, তাইজুল ইসলাম
সেরা গড় ৩৭.৮৪, সাকিব আল হাসান ২৩. ৪৭, মোস্তাফিজুর রহমান
সেরা বোলিং ৩৬/৭, সাকিব আল হাসান ৩৯/৮, তাইজুল ইসলাম
ম্যাচে ১০ উইকেট ১, মেহেদী হাসান মিরাজ
ইনিংসে ৫ উইকেট
মোট উইকেট ১৫৫ ২১৫

চিন্তার বিষয় হলো দলের পেসারদের অনভিজ্ঞতা। ৩২ উইকেট নিয়ে সবার ওপরে রুবেল হোসেন। কিন্তু এ কটি উইকেট পেতেই ২৪ টেস্ট খেলে ফেলা কিংবা এখনো ৭৭ গড় নিয়ে বোলিং করা রুবেলের দলে সুযোগ পাওয়া নিয়েই সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে ১৭ উইকেট নিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান। আর অর্ধযুগ ধরে জাতীয় দলের সঙ্গী হয়েও পিছিয়ে আছেন শফিউল ইসলাম (১৫)। তাসকিন-শুভাশিষদের উইকেট সংখ্যা কিংবা অনভিজ্ঞতাও একটা চিন্তার বিষয়। পেসবান্ধব উইকেটে দুই স্পিনার তাইজুল (৫৪) ও মিরাজকে (৪৩) একসঙ্গে দেখা যাবে কি না, এ নিয়েও যে সন্দেহ জাগছে। তবু সংখ্যার বিচারে ২০০৮ সালের চেয়ে এগিয়ে থাকছে এ বোলিং আক্রমণ।

‘অ্যাওয়ে’ সিরিজের হিসাব নিতে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিই সবচেয়ে কঠিন। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এমন এক সিরিজকে বেছে না নিলেই হয়তো ভালো করতেন সাকিব। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ৫১ টেস্টে ৩৫৯৪ রান ও ১৮৮ উইকেটের অভিজ্ঞতা হাতছাড়া করার বিলাসিতা যে বিশ্বের কোনো দলই দেখানোর সাহস করবে না!