সৌন্দর্যের মিলনমেলায় তাড়ুয়া সমুদ্র সৈকত

সমুদ্রের গর্জন যেন মানব আত্মার সাথে কথোপকথন করে। এখানে এলেই কেবল এটা উপলব্দি করা যায়। সৃষ্টির সৌন্দর্যের একচিলতে দারুণভাবে যেনো ফুটে উঠেছে তাড়ুয়া সমুদ্র সৈকতে।

দ্বীপ জেলা ভোলার মূল ভূখন্ড থেকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাম ‘ঢালচর’। এ দ্বীপের দক্ষিণ পাশেই অবস্থান একটি সৈকতের। দীর্ঘ মেঘনা নদী এখানে পেয়েছে বিশাল সমুদ্রে তটের দেখা। সেখানেই গড়ে উঠেছে অপরুপ সাজে সেজেছে বাংলাদেশের এক অপূর্ব লীলাভূমি। যার নাম ‘তাড়ুয়া সমুদ্র সৈকত’।

ভোলা জেলা সদর থেকে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার দূরে তারুয়া সমুদ্র সৈকতের অবস্থান। ১৩৫ কিলোমিটার পাকা সড়কে পর পনের কিলোমিটার নৌ-পথ পেরিয়ে সেখানে যেতে হয়। তারুয়ায় সকালের সূর্যটা যেমন হাসতে হাসতে ওঠে, তেমনি সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়াতে ছড়াতে মুখ লুকায়। এখানে এলেই বোঝা যাবে, কতটা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে প্রকৃতিতে।

ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের দক্ষিণ প্রন্তেই বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অপরূপ মায়াবি সৌন্দর্যে সেজে আছে তাড়ুয়া সমুদ্র সৈকত। এখানে রয়েছে প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, হরিণ,লাল কাঁকড়া, ২৩০ ফুট লম্বা কাঠের তৈরি ল্যান্ডিং স্টেশন, বিশাল কেওড়াও তারুয়া বন। রয়েছে গড়ান, রেইনট্রি, গেওয়াসহ নানা ধরনের গাছ। শীত এলেই দ্বীপে বসে অতিথি পাখির মিলনমেলা। এ দ্বীপে ভয়ংকর প্রাণী না থাকলেও রয়েছে শেয়াল, বন বিড়াল, সাপসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। সৈকতের সাদা বালিয়ারিতে পর্যটকদের জন্য রয়েছে ছাতা ও চেয়ার। চকচকে সাদা বালু আর এই বালিয়ারিতে লাল কাঁকড়ারা ছোট ছোট পা দিয়ে দৌড়ে চলে। তবে মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই ওরা লুকিয়ে যায় গর্তে । মাথার ওপর কিংবা বেলাভূমিতে বিভিন্ন প্রজাতির হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর চারপাশ। তবে শীতের সময় অতিথি পাখির বিচরণে এক অতি প্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বর্ণিল আলোকচ্ছটা মোহিত করবে যে কাউকে। নাগরিক ব্যস্তাতর বন্দিজীবনে অবকাশ যাপনের জন্য প্রকৃতি প্রেমীরা একটু সময় করে এখানে এলে প্রকৃতি তাঁদের নিরাশ করবে না।তারুয়া সমুদ্র সৈকতে পর্যটকরা একসঙ্গে উপভোগ করতে পারেন বিশাল সমুদ্রের বিস্তর্ণ জলরাশি, নানা ধরনের পাখিদের কল-কাকলি, বালুকাময় মরুপথ আর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ছায়াঘন মনকাড়া নিবিঢ় পরিবেশে সময় কাটানোর সুযোগ, বৈচিত্রময় প্রাণী আর সাগরের উত্তাল গর্জন। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে দ্বীপটিকে সাজিয়ে তুলেছে। বর্তমানে তারুয়া দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ব্যস্তময় জীবনের একঘেঁয়েমি থেকে অবকাশ যাপনের ইচ্ছায় ঘুরে আসার মতো একটি স্থান তারুয়া সমুদ্র সৈকত। উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন, কেওড়ার শ্বাসমূল, নির্মল বাতাস, সমুদ্রের তাজা মাছ দেখে যেকেউ প্রেমে পড়ে যাবে। প্রকৃতি প্রেমিরা ঘুরে এলেও মন রয়ে যাবে সেখানেই।

পর্যটকরা জানান, ছুটিতে প্রত্যেক শীতেই পরিবার পরিজন নিয়ে তাঁরা ঘুরতে আসেন তারুয়া দ্বীপে। এ যেন এক অন্যরকম অনুভুতি। বিচ্ছিন্ন এলাকায় এমন সমুদ্র সৈকত আর বিশাল জলরাশি পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। তেমনি মুগ্ধতায় বিমোহিত হন নীল অকাশের বর্ণচ্ছটায়।

যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে প্রতিদিন একাধিক লঞ্চ চরফ্যাশনের বেতুয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। লঞ্চগুলো ভোরবেলায় ঘাটে পৌঁছায়। লঞ্চে সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ডেক ভাড়া জনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। চরফ্যাশনের বেতুয়া ঘাটে নেমে ইজিবাইকে করে ৩০ টাকা দিয়ে চরফ্যাশন বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কচ্ছপিয়া অবধি বোরাক ভাড়া ৬০ টাকা। এসব জায়গায় মোটরসাইকেলও চলে, তবে সেক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হবে দ্বিগুণ। কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে (ভাড়া ১০০ টাকা) ঢালচর যেতে হবে।যাওয়ার পথে চিকন চিকন নদী দিয়ে যেতে বহু সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি পাখির কলকাকলি শুনতে পারবেন।
ঢালচর লঞ্চঘাট থেকে সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার পথ দুটি। এর মধ্যে একটি উপায় বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। তবে এ ক্ষেত্রে অনেক কষ্ট হবে। কারণ সেখানে কোনো মসৃণ রাস্তা নেই। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে কেওড়া বাগান। নতুন কারও পক্ষে হাঁটা অতটা সহজ নয়। অপরদিকে ট্রলার দিয়েও তারুয়া সমুদ্র সৈকতে যেতে পারবেন। এই একই ভ্রমণে পর্যটকরা চর কুকরি-মুকরি ইকোপার্কও ঘুরে আসতে পারবে।

যেখানে থাকবেন:
এ সমুদ্র সৈকতে থাকার কোনো আবাসিক হোটেল বা ডাকবাংলো নেই। তবে এখানে বেশ কিছু বাসায় থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এসব ঘরে জনপ্রতি ২০০-২৫০ টাকায় থাকা যায়। আর খোলা আকাশের নিচে তাবু করে থাকাটা উত্তম। স্থানীয়দের কাছ থেকেও তাবু ভাড়া নিয়ে এখানে থাকা যাবে। ক্যাম্পিংয়ের জন্য আদর্শ জায়গা বলা যেতে পারে এ সমুদ্র সৈকতকে।

যা খাবেনঃ
এই দ্বীপে নদী ও সাগরের নানা প্রজাতির সুস্বাদু মাছ পাওয়া যায়। তবে এখানকার হাঁসের মাংস ভুনা, মহিষের দুধের দই খুবই জনপ্রিয়।

কোথায় খাবেন:
এখানে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। তবে স্থানীয়দের সহায়তায় ইচ্ছেমতো রান্না করিয়ে খেতে পারবেন। অথবা নিজেরা রান্না করে খেতে হবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, পর্যটকদের নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ ভ্রমমের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া আছে।

পরিশেষে এটুকু বলতে হয় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে পর্যটন এলাকা, যেখান থেকে আয় হয় অজস্র বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তাড়ুয়ার দ্বীপের মতো এতো সুন্দর সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন দ্বীপ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা সত্ত্বেও এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে গড়ে ওঠেনি কোনো অবকাঠামো। তবে উন্নযন কোন পথে, প্রশ্ন থেকেই যায়।