ওয়েবসাইট তৈরি করায় স্কুলছাত্রকে হ্যাকারদের হুমকি কি আসলেই সত্য ?

গতকাল থেকে একটি সংবাদ বেশ ভাইরাল হয়েছে অনলাইনে। অনেক নামী দামী অনলাইন পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল সংবাদটি প্রচার করেছে। সংবাদে প্রকাশ ঝিনাইদহে পোস্টটাচ.কম ( posttouch.com ) নামে ফেসবুকের ন্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করেছে আবরার নুর অর্ণব নামে ৭ম শ্রেণির এক ছাত্র। ওয়েবসাইটটি তৈরি করার পর কয়েক বার হ্যাক করে হ্যাকাররা।

তবে ওয়েবসাইটটি পুরোটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারায় ওই স্কুলছাত্রকে মোবাইলে প্রতি মুহূর্তে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে হত্যার হুমকি দিচ্ছে হ্যাকাররা। নিরাপত্তার আশঙ্কায় প্রায় এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না স্কুলছাত্র অর্ণব ও তার পরিবার।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র অর্ণব। তার বাবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। থাকেন শহরের ব্যাপারীপাড়ার একটি ভাড়া বাড়িতে। ৫ম শ্রেণিতে পড়ার সময় সে কম্পিউটার চালানো শুরু করে। ইতিমধ্যে অর্ণব ওয়েবসাইট নির্মাণসহ কম্পিউটারের নানা বিষয় শিখেছে।

১৬ ডিসেম্বর থেকে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নতুন ওয়েবসাইট তৈরির কাজ শুরু করে। ১৮ এপ্রিল সে সফল হয়। নাম দেয় পোস্টটাচ.কম (posttouch.com)। নিজস্ব ডোমেইন কিনে চালু করে সাইটটি। ৬৪ জন তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাউন্ট খোলে। তৈরি করে পোস্টটাচ (posttouch.com) নামে অ্যাপ। তার এই সাফল্য চোখে পড়ে হ্যাকারদের।

গত ২২ মে প্রথম তার ওয়েবসাইট পোস্টটাচ হ্যাক করা হয়। অনেক চেষ্টার পর তা উদ্ধার করা হয়। আবারো হ্যাকড হয়। সর্বশেষ হ্যাকাররা এসকিউএল ইনজেকশান পুশ করে সব কিছু নষ্ট করে দেয়। এতেও দমেনি অর্ণব। নতুন করে আবারো শুরু করে ওয়েবসাইটির কাজ।

তবে বসে নেই হ্যাকাররা। অর্ণবের বাবা আব্দুল আলিমের মোবাইল ফোনে মুহূর্তে মুহূর্তে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছে তারা। বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে জানানো হলে বাড়িতে পুলিশের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

তবুও আতঙ্কিত অর্ণব ও তার পরিবার। বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না পরিবারের লোকজন। বন্ধ রয়েছে অর্ণবের লেখাপড়া। অর্ণবের বাড়িতে কে বা কারা কখন আসছেন বা কখন যাচ্ছেন তা মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে জানাচ্ছেন হ্যাকাররা। আর নিয়মিত চলছে হত্যার হুমকি। এমনকি সংবাদকর্মীদের যাওয়া ও আসার বিষয়েও ম্যাসেজ দিতে দেখা গেছে।

অর্ণবের বাবা আব্দুল আলিম বলেন, এ ঘটনার পর থেকে আমার পরিবার নিয়ে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। দ্রুত হত্যার হুমকিদাতা ও হ্যাকারদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

এ ব্যাপারে সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক শেখ বলেন, এ ঘটনায় অর্ণবের বাবা একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন জানান, বিষয়টি জানার পর থেকে তিনি অর্ণবের ও তার পরিবারে সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে তিনি সবসময় খোঁজ খবর রাখছেন।

তবে এ বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বানোয়াট বলে উড়িয়ে দিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন এই স্কুলছাত্র ও তার বাবা ওয়েবসাইটটির প্রচারের জন্য এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। এই posttouch.com সাইটটি একটি রেডিমেড স্ক্রীপ্ট দিয়ে তৈরি যার নাম WoWonder ( https://www.wowonder.com ) এবং যার ডেভেলপার তুরস্কের Deen Doughouz ( https://www.facebook.com/deendoughouz ) । স্ক্রীপ্টটির ডেমো পাওয়া যাবে এখানে https://demo.wowonder.com যার সঙ্গে অর্নবের সাইটের মিল পাওয়া যায়। এই স্ক্রীপ্টটি যে কেউ কিনে এমন একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে ফেলতে পারেন কয়েক মিনিটেই। অর্নব সেটি স্বীকার না করে নিজেই তৈরি করেছে দাবী করাকে তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা শিশুসুলভ আচরন বলছেন। ্তারা তার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন তবে মানুষকে প্রকৃত তথ্য না দিয়ে ভিন্ন কৌশলে প্রচারনাকে তারা প্রতারনা হিসাবে দেখছেন।

প্রায় দুই দশক ধরে তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা সামিউল ইসলাম সাংবাদিকদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাচাই বাছাই না করে এমন একটি সংবাদ প্রকাশ করায়। আমেরিকা প্রবাসী এই তথ্য প্রযুক্তিবিদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন “আমাদের এমন গাঁজাখুড়ি সাংঘাতিকরা কবে মানুষ হবে? তথ্য যাচাই বাছাই না করেই ২ কলাম লিখে দিল। এই ছেলে এবং তার বাবার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করা উচিত। একটা ৫৯ ডলারের স্ক্রিপ্ট কিনে সে কিনা দাবি করে এটা সে বানিয়েছে এবং তার জন্য হ্যাকাররা তাকে মৃত‌্যুর হুমকি দিচ্ছে। আবার নিউজটার শিরোনাম দেখেন ফেসবুকের ন্যায়। আরে গর্দভ রিপোর্টার এমন হাজার হাজার স্ক্রিপ্ট বানানোই আছে। কিছু ফ্রিতেও পাওয়া যায়। এমন সোসাল নেটওয়ার্ক সাইট তৈরী করতে বিশেষ কিছু লাগে না। আমাকে ৫৯ ডলার দিলে আমি স্ক্রিপ্টটা কিনে ইনস্টল করে দিয়ে আপনাকেও এমন ফেসবুকের ন্যায় সোসাল সাইটের মালিক বানিয়ে দিব। যত্তসববব। আমার লেখার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থাকলে কমেন্টস এর প্রথম লিংকটাতে গুতা মারেন সব গোমড় ফাঁস হয়ে যাবে।”

ফেসবুকের মত এমন সোস্যাল সাইট পৃথিবীতে হাজার হাজার আছে। কেউ কারো হুমকি দেয় না। সাইট হ্যাক হয় সার্ভারের বা সাইটের নিরাপত্তা ত্রুটির কারনে। হ্যাকাররা যে কোন সাইটকে হ্যাক করে নিতে চায় কিন্তু সাইটের শক্তিশালী নিরাপত্তার কারনে সেটি পারে না। এখানে একজন ডেভেলপার বা সার্ভার তদারককারীর দক্ষতার প্রশ্ন জড়িত। মাত্র ৬০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটা সাইট হ্যাক করে হ্যাকারদের কোন ফায়দা আছে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। এমন একটি সাইটের জন্য হত্যার হুমকি দেয়া নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে করেন তারা। জনাব জামান নামক একজন ঠিক এই কথাটিই তুলে ধরেছেন। 

বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তি ভিত্তিক মুক্ত পেশাজীবী তৈরিতে অগ্রনী ভূমিকা রাখা জনাব রাসেল আহমেদ প্রশ্ন রেখেছেন ” সাইট বানালে হত‍্যার হুমকি কেন দেবে সেইটাই তো বুঝলাম না ”

সবাই অন্য একটি প্রসঙ্গের দিকে ইংগিত করছেন। স্কুলছাত্র অর্নব ও তার বাবা প্রচারমুখী হয়ে এই সমস্ত প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রচারের আগেই অর্নব তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন এগুলি প্রচার হবে পরেরদিন।

তবে অর্নব নিজেই জানিয়েছেন তার ফেসবুক প্রোফাইল হ্যাক হয়েছিল এবং তিনি সেটা ফেরৎ পেয়েছিলেন। হ্যাকাররা তাকে ও তার আত্মীয় স্বজনকে নানাভাবে বিব্রত করেছে। প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকজন জানালেন মূল ঘটনা এটিই হতে পারে। তার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হলে তিনি সমস্যার সম্মুখীন হন। এই বিষয়টিকেই তিনি তার ওয়েবসাইটের নামে ব্যাবহার করে প্রচারের আলোয় আসতে চাচ্ছেন।

তথ্য প্রযুক্তিবিদ সামিউল ইসলাম নিজেও নিউইয়র্কের একটি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার নিজের ডোমেইন হোস্টিং এর ব্যবসা আছে। তিনি দেশে-বিদেশে অনেক ওয়েব সাইট তৈরি করেছেন। তার মতে অর্নবদের এখন শেখার বয়স। এ বয়সে তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শেখার পিছনেই তাদের মনোনিবেশ করা উচিৎ। ভাল কোন কিছু করতে পারলে এমনিতেই মানুষ জেনে যাবে। এভাবে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে প্রচারে আসতে চাইলে বরং তার নিজের জন্যই ক্ষতি হবে। তিনি ( অর্নব ) দক্ষতা অর্জন থেকে পিছিয়ে পড়বেন। জনাব সামিউল তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সাংবাদিকদেরকেও যাচাই বাছাই করে সংবাদ প্রচারের তাগিদ দিয়েছেন । প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।