‘হেফাজতকে আশকারা দিচ্ছে সরকার’

ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে সরকার আশকারা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশিষ্ট বেশ কয়েকজন নাগরিক। তারা বলছেন, এই সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা এখন অযাচিতভাবে নানা হুমকি ধামকি দিচ্ছে। এগুলো রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের চরিত্রকে নষ্ট করছে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুলতানা কামালসহ প্রগতিশীল নাগরিকদের হত্যা ও হামলার হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

সম্প্রতি একটি টেলিভিশন টকশোতে হেফাজত নেতার সঙ্গে বিতর্কে অংশ নেন সুলতানা কামাল। আর এ সময় দেয়া একটি বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে হেফাজতের সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, ‘তার (সুলতানা কামাল) হাড্ডি-গোশত রাখা হবে না। কাঁচা গিলে ফেলা হবে।’

সুলতানা কামালকে হুমকি দেয়ার প্রতিবাদে সিরডাপ মিলনায়তনে প্রতিবাদ সভা ডাকা হয় নাগরিক সমাজের ব্যানারে। এতে অধ্যাপক অজয় রায়, অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত, সাংবাদিক আবেদ খান, খন্দকার মনিরুজ্জামান, কলামিস্ট সোহরাব হাসান, শিক্ষাবিদ সাদেকা হালিম, অভিনেত্রী সারা জাকেরসহ বিশিষ্টজনেরা অংশ নেন।

প্রতিবাদ সভায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেসব টেলিভিশনের টকশোতে হেফাজতকে ডাকা হবে, তাদেরকে বর্জন করবেন তারা।

প্রধানমন্ত্রীই হেফাজতকে আশকারা দিচ্ছেন অভিযোগ করে অজয় রায় বলেন, কওমি মাদ্রাসা স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রীর ভুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেন, “এ নিয়ে মতিয়া চৌধুরীও পলিটিক্যাল বক্তব্য দিয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘তারা কি আমাদের ছেলে নয়। অবশ্যই আমাদের ছেলে, তাদের স্বীকৃতি দিন, তবে কারিকুলাম দিয়ে তাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। তার বক্তব্যও হেফাজতক আশকারা দিয়েছে।’

অজয় রায় বলেন, ‘হেফজত প্রধান শফি নারী সমাজকে তেঁতুলের সাথে তুলনা করেছেন। সেই হেফাজতের নির্দেশ অনুযায়ী পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তন করা হলো। ১৫/১৬টি চমৎকার প্রবন্ধ বাতিল করে দেয়া হলো, হিন্দু লেখকের বলে।’

‘হেফাজতকে প্রধানমন্ত্রী কেমন করে সাক্ষাৎ দেয়? তার সাক্ষাতের পরেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করা হলো। কারণ ওটা নাকি মূর্তি, পৃথিবীতে অনেক স্ট্যাচু আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত পূজা না করা হবে ততক্ষণ কোন ভাস্কর্য মূর্তি নয়।’

আবুল বারকাত বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ আজ অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অপরাজেয় বাংলাদেশ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে শিবির। ২০০৫ সালে একই সময় সারা দেশে জিহাদী ইশতেহার দিল জেএমবি। আর ২০১৩ সালে হেফাজতের ১৩ দফা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একই সূত্রে গাঁথা। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলা।’

দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মনিরুজ্জামান বলেন, ‘দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হেফাজতের আঘাত করছে সামাজিক, আর জামায়াত আঘাত করছে রাজনৈতিকভাবে। তাদের কাছে আমরা হেরে যাচ্ছি, আমরা এখন খুবই খারাপ অবস্থায় আছি। সম্মিলিতভাবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে এ দেশ অন্ধকারের যুগে চলে যাবে।

সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘একটি ধর্মশ্রায়ী কোন শক্তি সুলতানা কামালের ওপর হুমকি দিল শুধু তাই নয়। সমগ্র জায়গায় তাদের বিস্তার ঘটেছে। এদের সাথে আপসকামিতাও বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। আমরা এখন কৃষ্ণপক্ষের মধ্যে বিচরণ করছি, এই অবস্থায় আমাদের চুপচাপ বসে থাকার সময় নাই।’

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘২০১৩ সালে হেফাজত তাদের ১৩ দফা দিয়েছিল। ওই ১৩ দফায় নারীদের আঘাত করা হয়েছিল। সুলতানা কামাল হেফাজতের দফার সমালোচনা করায় আজ তার ওপর আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। যে প্লাটফর্ম থেকে তাকে (সুলতানা কামাল) আক্রমণ করা হলো, সেই বায়তুল মোকারমের কিছু দিন আগে মক্কা মদিনার ইমাম বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে তো নারীদের আক্রমণ করে বক্তব্য দেয়া হয় নাই।’

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সারা যাকের বলেন, ‘আমরা মনে হয় পারছি না, আস্তে আস্তে দেশটা পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে। ৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপির সমর্থন ছিল, ২০১২ তে শাহবাগ চত্ত্বরে আন্দোলন ছিল, সেখানেও আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল। ২০১৩ তে হেফাজত শাপলা চত্ত্বরে বসলে তাদের মতিঝিল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। সুলতানা কামালকে হুমকি দেয়া হলো, এখন কি হয়েছে? উগ্রপন্থিরা যাতে মাথা চাড়া দিতে না পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে।

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংস্কৃতি কর্মী রাফিউর রাব্বি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে হেফাজতকে দিয়ে মামলা করানো হয়েছে। কণ্ঠ রোধ করার জন্য এটা করা হয়ে থাকে। দুর্বত্ত রক্ষার রাজনীতি চলতে থাকলে, সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটবে।’

সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, ‘রাষ্ট্রের অবস্থান আজ অন্ধকার শক্তির দিকে। আমরা আশা করব রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, নাগরিক সমাজকে দূরে ঠেলে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা যাবে না। এই সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।