৩০ জুলাই নিয়ে কেন শঙ্কায় আসামের বাঙালিরা?

আগামী সোমবার প্রকাশিত হবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া- যা নিয়ে আসামের কয়েক লাখ বাংলাভাষী মানুষ, বিশেষ মুসলমানরা আশঙ্কায় আছেন যে তাদের নাম ওই তালিকায় থাকবে কি না।

‘আমরা ৩০ জুলাইয়ের জন্য দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করছি। শুধু আমরা আসামি বাঙালিরা নই, অন্য অনেক গোষ্ঠীর মানুষই অপেক্ষা করে আছে ওই দিনটার জন্য।’ বরাক উপত্যকার শিলচর শহরের বাসিন্দা এবং আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বিবিসি বাংলাকে এভাবেই তার শঙ্কার কথা জানান।

তার মতোই আগামী ৩০ জুলাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন রাজ্যের একেবারে অন্য প্রান্তে, বাকসা জেলার শালবাড়ির বাসিন্দা ছাত্রনেতা ইব্রাহিম আলি। তিনি বলেন, ‘আমরা তো আশঙ্কায় আছি ওই দিন অনেক ভারতীয় নাগরিকের নামও না নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়ে যায়।’

আসাম রাজ্যে ১৯৫১ সালের পর এই প্রথমবার নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করা হচ্ছে। নাগরিক পঞ্জী থেকে কারো নাম বাদ যাওয়ার অর্থ, তাদের অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে। ভারতীয় নাগরিকত্ব খুইয়ে তারা অচিরেই পরিণত হবেন রাষ্ট্রবিহীন মানুষে।

ইতিমধ্যেই বিদেশি বলে বহু মানুষকে চিহ্নিত করেছে আসামের ফরেনার্স ট্রাইবুনালগুলি। প্রায় নয় শ মানুষ আটক রয়েছেন বন্দী শিবিরে।

বঙ্গাইগাঁও জেলার বাসিন্দা ও সারা আসাম বাঙালি ছাত্র যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট ভাওয়াল বলছিলেন, ‘এমন বহু মানুষকে বিদেশি বলে রায় দিয়েছে ট্রাইবুনালগুলো, যাদের সব নথিপত্র থাকা স্বত্ত্বেও শুধু শুনানির দিন হাজিরা দেয়নি বলে একতরফা রায় হয়ে গেছে।’

‘পুলিশও আগে হাজিরার নোটিস দেয়নি, তাই এরা জানতেই পারেনি যে তাদের নামে ট্রাইবুনালে মামলা হয়েছে। অথচ সেই পুলিশই বিদেশি রায় হওয়ার আধ ঘণ্টার মধ্যে লোককে খুঁজে বার করে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। ছবি আর আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। অনেক মানুষ এভাবে বিদেশি বলে চিহ্নিত হয়ে গেছেন।’

হঠাৎ করে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার কারণ হলো ৩১ ডিসেম্বর মাঝ রাতে প্রকাশিত হওয়া আংশিক খসড়া নাগরিক পঞ্জী।

প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলছিলেন, ওই তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল বহু ভারতীয় নাগরিকের নাম, যার মধ্যে তার নিজের পরিবারের সদস্যদের নামও ছিল না।

তার কথায়, ‘এই যে আশঙ্কাটা তৈরি হয়েছে, তার যে একেবারে ভিত্তি নেই, তা তো নয়। ৩১ ডিসেম্বর যে আংশিক খসড়া প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে বহু সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিকের নাম ছিল না। এদের অনেকেই পুরুষানুক্রমে আসামের বাসিন্দা এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তবুও তাদের নামও যখন বাদ পড়ে, তখন আশঙ্কা তো থাকবেই সাধারণ মানুষের মধ্যে।’

আসামের জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে যে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষ আসামে ঢুকে পড়েছেন। এই কথিত বিদেশিদের চিহ্নিত করতেই জাতীয় নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার দাবি ওঠে।

কিন্তু খসড়া তালিকায় দেখা গেছে, বহু ভারতীয় নাগরিকের নামও বাদ পড়েছে, যেমন শালবাড়ির বাসিন্দা ছাত্রনেতা ইব্রাহিম আলির গোটা পরিবারের নামই ওই খসড়া তালিকায় ছিল না।

‘এর আগে যখন এনআরসি [জাতীয় নাগরিক পঞ্জী] হয়েছিল ১৯৫১ সালে, সেখানে আমার দাদুর নাম ছিল। আমার দাদুর নাম ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে জমির খাজনা দিয়েছি, তার রসিদ আছে। তবুও আমাদের গোটা পরিবারের কারো নাম আংশিক তালিকায় ওঠেনি’, বলেন আলি।

শুধু যে বাংলাভাষীদের নাম বাদ পড়েছিল ওই তালিকা থেকে তা নয়। বাদ গেছে অনেক অসমীয়া মানুষের নামও।

নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার পেছনে যে ছাত্র সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে, সেই অতি শক্তিশালী অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা আসুর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘এটা ঠিকই, প্রথম খসড়া তালিকায় অনেক সত্যিকারের ভারতীয় নাগরিকের নাম বাদ গেছে। শুধু বাংলাভাষী নয়, অনেক অসমীয়া মানুষেরও নাম বাদ গেছে।’

‘আমার নিজের পরিবারের কিছু সদস্যের নামও ছিল না সেখানে। কিন্তু ওই আংশিক তালিকার পর একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া হয়েছে – সত্যিকারের নাগরিক, যারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে এসেছেন, তাদের নাম নিশ্চই চূড়ান্ত তালিকায় থাকবে। এতে বাংলাভাষী মানুষদের আতঙ্কিত হওয়ার কী আছে!’

তিনি আরও দাবি করছিলেন, আসু কখনই নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার দাবিটাকে বাঙালিবিরোধী বা মুসলমান বিরোধিতার জন্য করেনি। অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করার জন্যই এই দাবি।

ভট্টাচার্যের সংগঠন আসুর নেতৃত্বেই ৮০-র দশকে চলেছিল রক্তক্ষয়ী আসাম আন্দোলন- যার সমাপ্তি হয়েছিল ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তির মাধ্যমে। ওই চুক্তির একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদ করার প্রতিশ্রুতি।

যেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, সেই ২৫ মার্চকে ভিত্তি তারিখ ধরা হয় -অর্থাৎ তার আগে পর্যন্ত যারা আসামে এসেছেন, তাদের বৈধ ভারতীয় বলেই ধরা হবে। তারপর আসা মানুষদের ঘোষণা করা হবে অবৈধ বিদেশি।

চুক্তির প্রায় তিন দশক পর শুরু হয় নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদের সেই কাজ। প্রায় তিন বছর ধরে ৪০ হাজার কর্মী-অফিসার নাগরিক পঞ্জী হালনাগাদের কাজ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে।

আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী প্রকাশের প্রধান অফিসার, প্রতীক হাজেলার কাছে বাংলাভাষীদের এই আশঙ্কার প্রসঙ্গ তোলা হলে তিনি বলেন, ‘আশঙ্কা তো তখনই তৈরি হয় যদি কারও প্রতি অবিচার করা হয়। এক্ষেত্রে যারা নাগরিকত্বের জন্য নথি প্রমাণ পেশ করতে পারেননি, তাদের যদি তালিকার বাইরে রাখা হয়, তাহলে অবিচারটা হলো কোথায়? তাই আশঙ্কাই বা কেন তৈরি হবে? চূড়ান্ত খসড়ার পরও যদি কোনো সত্যিকারের ভারতীয়ের নাম বাদ যায়, তিনি তো এক মাসের মধ্যে আবারও দাবি পেশ করতে পারবেন!’

নাগরিক পঞ্জী প্রকাশ নিয়ে আসামের বাংলাভাষী মুসলমান-হিন্দুদের যে আশঙ্কা অমূলক সেই কথাটা বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা ও লেখক হিরণ্য কুমার ভট্টাচার্য।

তার কথায়, ‘যারা আশঙ্কার কথা বলছে, নিশ্চয়ই তাদের আশঙ্কার কোনো কারণ রয়েছে। যদি সত্যিই কেউ ভারতীয় নাগরিক হয়, তাহলে কেন তারা ভয় পাবে? তাদের তো আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। আসলে নাগরিক পঞ্জী নিয়ে এই আশঙ্কা, আতঙ্ক এগুলো একটা স্বার্থান্বেষী মহল তৈরি করছে।’

‘অসমীয়া বিরোধী একটা মহল তো সব সময়েই সক্রিয়, যারা চায় না নাগরিক পঞ্জীর কাজ শেষ হোক। এই প্রক্রিয়া কখনই বাঙালীবিরোধী বা মুসলমানবিরোধী নয়।’

অন্যদিকে, বাঙালি প্রধান বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ মনে ঠিক বিপরীত ধারণাটাই রয়েছে।

কথা হয় শিলচরের দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ কাগজের সম্পাদক তৈমূর রাজা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘আশঙ্কার কথা আমরা বলার থেকেও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো যে, সরকার নিজেই তো বলছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ নিয়ে যে কোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় তারা তৈরি। তাতেই তো প্রমাণিত হয় যে তারাও আশঙ্কা করছেন যে, কিছু একটা অঘটন ঘটছে আর মানুষ যদি প্রতিবাদ করেন, রাস্তায় নামেন, সেটা প্রতিহত করার জন্য প্রশাসনও তৈরি।’

‘একটা ষড়যন্ত্র নিশ্চয়ই চলছে। কারণ গত দুটো আদমশুমারিতে দেখা যাচ্ছে যে, বাঙালির সংখ্যা বেড়ে গেছে।’

‘মূলত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষী হিন্দু আর তাদের থেকেও বেশি সংখ্যায় মুসলমানরা, যারা নিজেদের মাতৃভাষাকে আগে অসমীয়া বলে উল্লেখ করতো, তারা মার খেতে খেতে এখন বাধ্য হয়ে জনগণনায় নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা বলে উল্লেখ করছে। তাই অসমীয়াদের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে যে বাঙালিরা না সংখ্যাগুরু হয়ে যায়,’ বলেন তৈমূর রাজা চৌধুরী।

এই নাগরিক পঞ্জী নিয়ে বাঙালি-অসমীয়া এক প্রকার বৈরিতা শুরু হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। কিন্তু গোহাটির প্রবীণ সাংবাদিক ও অসমীয়া ভাষার সংবাদ চ্যানেল প্রাগ নিউজের প্রধান সম্পাদক অজিত ভুঁইঞার মতে বাঙালি-অসমীয়া বৈরিতা এখন প্রায় নেই।

তিনি বলেন, নাগরিক পঞ্জীর ইস্যুটাকে কাজে লাগাচ্ছে কিছু রাজনৈতিক নেতা।

তার মতে, ‘ঠিকই একটা সময়ে আমাদের মধ্যে একটা টেনশন ছিল। কিন্তু সেসব এখন অতীত। অসমীয়া সমাজ স্বীকার করে এ রাজ্যে বাঙালিদের কন্ট্রিবিউশন। আসলে এই ইস্যুটাকে নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ, যারা রাজনীতি করে, তারা বিষয়টাকে হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতিতে নিয়ে যাচ্ছে এবং গোটা এনআরসি প্রকাশের ব্যাপারটাকেই বানচাল করে দিতে চাইছে। সেটা করতে পারলে তো রাজনীতির একটা চ্যাপ্টারই বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘একবার যদি বিদেশি চিহ্নিতকরণ হয়ে যায়, তাহলে কেউই তো আর মুসলিমদের বা বাঙালি হিন্দুদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। সেজন্যই খুব সুচিন্তিতভাবে এই আশঙ্কাটা তৈরি করা হয়েছে। ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে,’ বলছিলেন ভুঁইঞা।

নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ নিয়ে বাংলাভাষী মানুষরা যেখানে বিদেশি বলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন আর অসমীয়ারা যেখানে বলছেন সত্যিকারের নাগরিক যেসব বাঙালি, তাদের আশঙ্কার কারণ নেই, সরকার আর পুলিশ প্রশাসনে ব্যস্ততা তুঙ্গে।

এ বিষয়ে কথা হয় আসাম পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান পল্লব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা বেশ কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছি, যেখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। আসামে বেশ কিছু মৌলবাদী শক্তি তো সক্রিয়। নাগরিক পঞ্জী নিয়ে সেই সব শক্তির পাশাপাশি ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকেও বেশ কিছু সংগঠন এ নিয়ে আসরে নেমেছে। তাদের সবাইকেই নজরে রাখা হয়েছে। সেনা, আধাসামরিক বাহিনী আর পুলিশবাহিনীকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এ ছাড়াও আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা সচেতনতা প্রচার চালাচ্ছি যে, এনআরসি বেরুনো মানেই এটা নয় যে, যাদের নাম বাদ যাবে তারা বিদেশি বলে চিহ্নিত হয়ে যাবে। দাবি পেশ করার এক মাস সময় আছে- এটাও প্রচার করছি আমরা।’

এইসবের মধ্যেই ৩০ জুলাই দিনের বেলায় প্রকাশিত হবে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া। সেটা যেমন টাঙিয়ে দেওয়া হবে নাগরিকপঞ্জী সেবা কেন্দ্রগুলিতে, সেরকমই ওয়েবসাইটেও দেখা যাবে, আর এসএমএস করেও জেনে নেওয়া যাবে নিজের নাম তালিকায় আছে কি না।

যাদের নাম এই তালিকায় থাকবে না, তারা এক মাস সময় পাবেন পুনরায় দাবি জানাতে।

তবে অনেকেই বলছেন, ইতিমধ্যেই সব নথি জমা করেও যদি নাম বাদ যায়, তাহলে পরের এক মাসে দাবি জানাতে নতুন আর কী নথি জমা দেওয়া সম্ভব?