বাবারা থাকেন কন্যাদের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে, থাকে না?
রিমি রুম্মান, যুক্তরাষ্ট্র : ২০০৮ সাল গত হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। সেবার দেশে গিয়ে দেখি বাবা আগের চেয়ে বেশ বুড়িয়ে গেছে। চলাফেরার শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। বাসার পাশের মসজিদে নামাজ আদায় করে। তখন বাবার পৃথিবী বলতে ওইটুকুনই।
দেখতে দেখতে আমার নিউইয়র্ক ফিরে আসবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সকালের লঞ্চে ঢাকায় ফিরতে হবে। প্রতিবার ফিরবার সময় বাবা ঢাকা পর্যন্ত সাথে থাকেন। ভেবেছিলাম সেবার একাই ফিরতে হবে। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে বললেন, আমার সাথে ঢাকা পর্যন্ত আসবেন। আমি রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বলি, ‘পারবেন?’ বাবার চোখ জোড়ায় শিশুসুলভ আনন্দ খেলে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তীব্র এক আত্নবিশ্বাসে বলেন, ‘তুই সাথে থাকলে আমি দুনিয়ার সবখানেই যাইতে পারুম, বুঝলি বুড়ি?’
ভোরের লঞ্চে আমরা পিতা-কন্যা বহুদিন পর একসাথে রিক্সার হুড ফেলে চললাম লঞ্চঘাটের দিকে। চিৎকার করে পৃথিবীকে জানান দিতে ইচ্ছে হলো। বলতে ইচ্ছে হলো, ‘পৃথিবীর মানুষেরা, দ্যাখো এইটা আমার বাবা, আমি তাঁর রাজকন্যা। ‘
ডানে-বাঁ’য়ে তাকাই। সকালের নীরব মফঃস্বল শহর। দু’একটা নেড়ি কুকুর হেঁটে যায় পাশের রেললাইন ধরে। বড় রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট তখনো খোলেনি। কেউ দেখেনি ওপথে সকালের বিশুদ্ধ বাতাস কেটে কেটে পৃথিবীর সব সুখ গায়ে মেখে কন্যার হাত ধরে একজন বাবার সে যাত্রা।
লঞ্চের দোতলায় ডাবল কেবিন, দু’টো বিছানায় আমরা দু’জন। তিন ঘণ্টার লঞ্চ জার্নিতে বাবা তাঁর গোটা জীবনের গল্পই বলে গেলেন। ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত সংগ্রাম করে উঠে আসার গল্প। সাত বছরের পিতৃহীন এক বালকের কঠিন যুদ্ধ করে টিকে থাকা, নিজের চেষ্টায় সৎভাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গল্প। শুনতে শুনতে কখনো আঁতকে উঠেছি, কখন দু’চোখ ছলছল করে উঠেছে, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়েছে বারংবার। আবার গর্বে মাথা তুলে তাকিয়েছি। অতঃপর বাবার পাশে এসে বসি। বলি, ‘আব্বা, এই যে জীবনের এতটা পথ পার করে আসছেন, কোন কষ্টবোধ আছে?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, জানালা দিয়ে বাইরের উত্তাল জলের দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, যখন তোরা ছোট ছিলি, হাতে টাকা কম ছিল, তোদের অনেক সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারি নাই। এখন হাতে টাকা আছে, কিন্তু তোদের সেই ছোটছোট আব্দারগুলা তো নাই। ‘
আমি কিছুক্ষণ নিরুত্তর বসে থাকি। বাবার প্যারালাইজড শীতল হাতখানা হাতে নিয়ে বলি, ‘আব্বা, আমরা তো ভালই আছি। শুধু একটাই অভাব, আপনাদের কাছে না পাওয়ার অভাব। মন চাইলেই ছুটে আসতে পারি না, ছুঁইতে পারি না। ‘ বাবা মলিন চেহারায় জল টলমল। ঘোলাটে চোখে তাকালেন, সচল হাতটি আমার মাথায় বুলালেন। নিস্তব্দতায় ছেয়ে থাকা রুমটির বাইরে হুইসেল বেজে উঠলো। ততোক্ষণে ‘ঈগল’ নামের চাঁদপুর থেকে ঢাকাগামী লঞ্চটি সদরঘাট এসে পৌঁছেছে।
আমাদের পিতা-কন্যা’র সে-ই শেষ বার দেখা।
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে চলে গেছেন বাবা ২০১০ এ।
আজ ১২ই জুন বাবার মৃত্যুবার্ষিকী…
বাবারা থাকেন কন্যাদের সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে, থাকে না?
ভলো থাকুন সকলে …
(লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন