সরকার কয়েকশ গুম ও নিখোঁজের ব্যাপারে নীরব : এইচআরডব্লিউ

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে শত শত মানুষকে গুম আর গোপন আটকের অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এ কথা জানা গেছে। ওই প্রতিবেদনে ২০১৩ সাল থেকে ওই মানুষদের অবৈধভাবে আটক এবং গোপন স্থানে রাখার অভিযোগ তুলেছে সংস্থাটি। তাদের দাবি, বাংলাদেশ সরকার হয় এইসব অভিযোগ নাকচ করে আসছে, অথবা নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত, নিখোঁজদের পরিবারের কাছে ব্যাখ্যা সরবরাহ আর জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছে এইচআরডাব্লিউ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘নিরব’ অবস্থানেরও সমালোচনা করেছে সংস্থাটি। ন্যয়বিচার নিশ্চিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনকে তদন্তকাজে নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

এইচআরডাব্লিউ-এর ৮২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম , ‘তিনি আমাদের কাছে নেই: বাংলাদেশে গোপন আটক আর গুম’, যেখানে অন্তত ৯০ জনের তথ্য রয়েছে, যাদের শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই গুম করা হয়েছে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে শত শত মানুষ গুম কিংবা গোপন আটকের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন বিরোধী নেতাও রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগকে এক সপ্তাহ বা একমাস গোপন স্থানে আটকে রাখার পর আদালতে হাজির করা হয়েছে।

৯০জনের মধ্যে তিন বিরোধী নেতার তিন সন্তান রয়েছে, যাদের একজন ছয়মাস পরে ফিরে এসেছেন। বাকি তিনজনের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালের প্রথম পাঁচ মাসে এরকম ৪৮জনের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, বলছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।তাদের কাছে তথ্য থাকার দাবি করে সংস্থাটি বলছে, এরকম আটক ২১জনকে পরে হত্যা করা হয়েছে আর নয়জনের কোন তথ্যই আর জানা যায়নি।

এ ধরনের ঘটনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের, যে সংস্থা দুটির বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের দীর্ঘ অভিযোগ রয়েছে। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি আদনান চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায় র্যাবের সদস্যরা। তার বাবা রুহুল আমিন চৌধুরী সংস্থাটিকে বলছেন, পরদিন র্যাব সদস্যরা তাদের ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।”তারা বললো, আমরা তাকে নিয়ে যাচ্ছি, আমরাই আবার তাকে ফেরত দিয়ে যাবো। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে”, সংস্থাটিকে বলেছেন রুহুল চৌধুরী।

ওই প্রতিবেদনে বিরোধী বিএনপির ১৯জন কর্মীর তথ্য রয়েছে, যাদের ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পূর্বে বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারের কাছে একজন জ্যেষ্ঠ র্যাব কর্মকর্তা গোপনে জানিয়েছেন, সুমনসহ আরো পাঁচজন তার হেফাজতে ছিল। কিন্তু তিনি তাদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর অন্য র্যাব কর্মকর্তারা তাদের নিয়ে যান। তার ধারণা, এই ছয়জনের কেউ বেঁচে নেই।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, এ ধরনের আটকের ঘটনা সবসময়ে অস্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তারাও তাদের এই দাবির সমর্থন দিয়ে আসছেন। বরং কখনো কখনো উল্টো বলা হয় যে, এসব ব্যক্তিরা নিজেরাই লুকিয়ে রয়েছেন।

‘নিখোঁজের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকলেও, বাংলাদেশের সরকার এই বিষয়ে আইনের খুব একটা তোয়াক্কা করছে না”। অভিযোগ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস-এর।তিনি বলছেন, ‘মানুষকে আটক করে তারা দোষ নির্ণয়, শাস্তি নির্ধারণ, এমনকি তারা বেঁচে থাকবে কিনা; সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও যেন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া হয়েছে।’

প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে নিখোঁজ পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ একশোজনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সেখানে পুলিশের কাছে করা অভিযোগ ও অন্যান্য আইনি কাগজপত্রও রয়েছে। সংস্থাটি বলছে, এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলেও তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এ ধরণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও গ্রহণ করে না পুলিশ। তারা মনে করছে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে এসব অভিযোগ তদন্ত করার আহবান জানানো এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

ব্রাড অ্যাডামস বলছেন, ‘বাংলাদেশের সরকার এমনকি এসব অভিযোগ নাকচ না করে নীরব থাকছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চুপ করে থাকছে।এই নীরবতার অবসান হওয়া উচিত’, বলছেন অ্যাডামস। অবিলম্বে এই প্রবণতা বন্ধ করে অভিযোগের তদন্ত করা, নিখোঁজদের পরিবারের কাছে ব্যাখ্যা তুলে ধরা আর জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে সংস্থাটি।