বৃষ্টিতে পাহাড়ের ঢলে মিশে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের চোখের জল
টানা কয়েক দিন ধরেই চলছে ভারি বর্ষণ। ফলে পাহাড় বেয়ে নামছে ঢল। সমতল ও নিচু এলাকায় জমছে বৃষ্টি ও ঢলের পানি। এতে ভেসে গেছে পলিথিনে সাজানো ঝুপড়ি সংসার। ওপারে মৃত্যুর তাড়া খেয়ে এপারে এসে একটু স্থিমিত হতে না হতে প্রকৃতি আবার বিরূপ আচরণ করছে। পানির তোড়ে ভেসে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। আশ্রয়স্থলে পানি জমে কয়েক ফুট স্থিতি হয়েছে। চুলা জ্বালানো দূরে থাক বসে থাকারও জায়গা নেই। এতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন লাখো রোহিঙ্গা। মাথায় পুটলা ও অন্য সম্বল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটছে অনিশ্চিত গন্তব্যে। উখিয়ার পালংখালীর বালুখালী খালের পাড়ে সমতল এলাকায় আশ্রয় শিবির বানানো রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর মাঝে মঙ্গলবার বিকেলে এ চিত্র দেখা গেছে।
কক্সবাজার জেলায় শনিবার মাঝ রাতে থেমে থেমে ভারি বর্ষণ শুরু হয়েছে। সেই থেকে দিন রাত সমান তালে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামছে। কিছু কিছু সময় বৃষ্টি থামলেও ভারি বর্ষণে নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে সর্বস্ব হারিয়ে আসা অসহায় মানুষগুলো। বৃষ্টির সঙ্গে পাগলা বাতাস উড়িয়ে নিয়েছে অসংখ্য ঝুপড়ির পলিথিনের চালা। এরপরও অসহায় মানুষগুলোর ভেজা ছাড়া উপায় ছিল না। কোলের শিশুটির মাথা বাঁচাতে বুকের আচলটিই সম্বল করেছেন অনেক মা। এসব অসহায়ত্বে নিরবে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। আর পাহাড়ের ঢলের সঙ্গে মিশে গেছে অসহায় মানুষের চোখের জল।
পালংখালী ও কুতুপালংয়ের পাহাড়ের পাদদেশে ও খোলা মাঠে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের মাত্রা বেশি। রাতভর বৃষ্টিতে ভিজেছেন তারা। সকালের আলো ফোটার পর থেকেই এদের অনেক পরিবারে পুরুষটি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ত্রাণের আশায় ছুটেছেন নানা স্থানে। জেলা প্রশাসনের নির্দিষ্ট করে দেয়া ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলেই হামলে পড়ছেন। কেউ নিতে পারছেন কেউ পারছেন না। এভাবেই চলছে নিজ দেশে পাশবিকতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জীবন।
প্রতিনিয়তই সংকট মোকাবেলা করছেন তারা। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া ডিগ্রি কলেজ এলাকা থেকে কুতুপালং-পালংখালী নতুন শরণার্থী শিবির এবং হোয়াইক্যং উনচিপ্রাং এলাকা পর্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশুদের বিচরণ দেখা গেছে।
পালংখালীর বালুখালী খালের পাশে কথা হয় জাহেদা বেগম (৩১) নামে এক রোহিঙ্গা নারীর সঙ্গে। তিনি বলেন, খালের ওপারের খোলা মাঠে ৫শ’র বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলাম। কুরবানির ঈদের পরের দিন থেকে পরিবারের ৫ সদস্য নিয়ে এলাকার অন্যদের সঙ্গে ৬ হাত বাই ১০ হাত পরিধির জমি আয়ত্বে নিয়ে আমরা উপরে পলিথিন টানিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাই বানিয়েছিলাম। কিন্তু চলমান বৃষ্টি ও বাতাস ঝুপড়ির চালা উড়িয়ে নিয়ে যায়। খালে নামা পাহাড়ি ঢল তলিয়ে নিয়েছে ঝুপড়ির ভেতর থাকা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। এতে শিশুসহ পরিবারে সবাই ভিজেছি। সকাল থেকে রান্না হয়নি। বৃষ্টিও কমছে না, পেটের ক্ষুধাও মানছে না। তাই সব গুছিয়ে নিয়ে অন্য কোনো উচু জায়গায় ঝুপড়ি গাড়তে দু’সপ্তার সংসার ছাড়ছি।
সরেজমিন দেখা গেছে, জাহেদার মতো এখানকার খোলা জায়গাটিতে বসবাস গাড়া শত শত পরিবার পানিতে ডুবে থাকা পালংখালী খালের বাঁশের সাঁকো পার হয়ে আসছে। সবার কোলে-কাঁধে শিশু ও নিত্য প্রযোজনীয় জিনিসপত্র ভর্তি বস্তা। শুধু এরাই নয়, পালংখালীর পাহাড়ে গড়া নতুন ক্যাম্পেও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবছার কামাল বলেন, বালুখালী ক্যাম্পে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। কেউ স্বচ্চল নয়। সবাই পলিথিনের চালায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করলেও ঝড়ো হাওয়ায় অনেক বিপন্ন হয়েছেন। তাদের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
টেকনাফ-উখিয়া সড়কের দুই পাশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ শিশু পলিথিন কিংবা ছাতা মাথায় দিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। ত্রাণের গাড়ি এলে কিংবা চলতি পথে কোনো গাড়ি থেকে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে দেখতে পেলে তারা ত্রাণের জন্য ছুটছেন। বৃষ্টির পাশাপাশি ক্ষুধার জালা থেকেও পরিত্রান চাচ্ছিলেন তারা।
কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ উজ্জল কান্তি পাল জানান, সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৫৯ মিলিমিটার। এধরনের বর্ষণ আরও দু’দিন অব্যাহত থাকতে পারে। সঙ্গে ঝড়ো হাওয়াও হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন