নির্বাচন: এবার আ.লীগে এত মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন?
আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি করেছে মোট চারদিন৷ ৯ থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে এই বিক্রির কার্যক্রম চালানো হয়৷ প্রতিটি ফর্ম বিক্রি হয় ৩০ হাজার টাকায়৷ মোট ফর্ম বিক্রি হয় চার হাজার ২৩টি৷ ফর্ম বিক্রি করে আওয়ামী লীগের আয় হয়েছে ১২ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা৷
একটি আসনের জন্য সর্বোচ্চ ৫২টি ফর্মও বিক্রি হয়েছে৷ আর সেই আসনটি হলো বরগুনা-১৷ এছাড়া নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে বিক্রি হয়েছে ৪০টি ফর্ম, রংপুরের কুড়িগ্রাম-৪ আসনে ৩০টি এবং কক্সবাজার-১, নেত্রকোনা-১ ও ঝিনাইদহ-২ আসনে ২৬টি করে মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি হয়েছে৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যাও অবাক করেছে৷ সেখানে মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে মোট ২০টি৷
বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু৷ তিনি ছাড়াও এই আসনের জন্য আরো যে ৫১ জন মনোনয়ন ফর্ম কিনেছেন, তাঁদের একজন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গির কবির৷ এত বেশি প্রার্থী হওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই মনোনয়নপত্র কিনেছি৷ আমরা চাই তাঁকে যেন দল মনোনয়ন না দেয়৷ এ জন্য আমরা ৫১ জন এক জোট হয়ে মনোনয়ন ফরম কিনেছি৷ এর আগে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও তাঁর দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ জমা দিয়েছি৷ তাঁকে ছাড়া অন্য যে কাউকে দল মনোনয়ন দিলে আমাদের আপত্তি থাকবে না৷”
গত বুধবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়নপ্রতাশীদের সঙ্গে কথা বলেছেন৷ সেখানে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী এবং দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন৷ প্রার্থীদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেননি৷ গণভবনের ওই অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গির কবিরও ছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বরগুনাসহ বেশ কিছু আসনে এত বেশি মনোনয়ন প্রত্যাশী দেখে প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হয়েছেন৷ তিনি বলেছেন, নেতৃত্বের সংকটের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ আমি বুঝতে পেরেছি ওইসব এলাকায় নেতৃত্ব নেই৷ কিছু এমপি এলাকার নেতা-কর্মীদের আস্থা হারিয়েছেন৷”
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বরগুণা-১ আসনের এমপি এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এত মনোনয়ন প্রার্থী কেন, তা আমি জানি না৷ এর কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ যাঁদের ইচ্ছা হয়েছে, তাঁরা হয়েছে৷”
তিনি দাবি করেন, ‘‘এটা আমার প্রতি ক্ষোভ বা অনাস্থার কারণে হয়নি৷ নেতৃত্বের সংকট সবখানেই হয়েছে৷”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নমিনেশন চেয়েছেন৷ তাঁর পক্ষে আরো ১২-১৩ জন মনোনয়ন ফর্ম কিনেছেন৷ এখন মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যানরা মনে করেছেন, তাঁরা নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন৷ তাই তাঁরাও কিনেছেন৷” টেলিফোনে কথা বলার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং এই প্রতিবেদকের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন৷
আরো কয়েকজন মনোনয়প্রত্যাশী জানান, প্রধানমন্ত্রী এই নেতৃত্ব সংকটে হতাশা প্রকাশ করেছেন৷ তাই তিনি বলেছেন দল যাঁকে মনোনয়ন দেবে, তাঁর জন্যই কাজ করতে হবে সবাইকে৷ কেউ এর বিপরীত কিছু করলে তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় করা হবে৷ তিনি এবারের নির্বাচন সহজ হবে না বলে সবাইকে সতর্ক করেছেন বলেও জানিয়েছেন তাঁরা৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন মনোনয়ন প্রত্যাশী জানান, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নেতৃত্বের কী ভয়াবহ ধস যে, কোনো কোনো এলাকায় একটি আসনে ৪০-৫০ জন প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র কিনেছেন৷”
মাগুরা-২ আসন থেকে মনোনয়পত্র কিনেছেন ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি ড. ওহিদুর রহমান টিপু৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গণভবনে প্রধানমন্ত্রী এত বেশি মনোনয়নপত্র কেনা সম্পর্কে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগে অনেক নেতা-কর্মী বেড়েছে৷ অনেকেই নির্বাচন করতে চান৷ তবে কোনো কোনো এলাকায় একই আসনে ৪০-৫০ জন মনোনয়ন ফর্ম কিনেছেন৷ এটা ভালো দেখায় না৷ পরস্পরের প্রতি সম্মান থাকে না৷ এটা নেতৃত্বের দুর্বলতা৷ কোনো কোনো এলাকার এমপি বা নেতার বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে এর মাধ্যমে৷”
তিনি জানান, ‘‘নেত্রী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, মাঠ জরিপের মাধ্যমে মনোনয়ন দেয়া হবে৷ যাঁর জনপ্রিয়তা আছে, তাঁকেই মনোনয়ন দেয়া হবে৷ মুখ দেখে কোনো মনোনয়ন দেয়া হবে না৷ আর যাঁকে দল মনোনয়ন দেয়া হবে তাঁর জন্যই সবাইকে কাজ করতে হবে৷ আমিও মনে করি, যদি এভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে যোগ্য প্রার্থীরাই মনোনয়ন পাবেন৷”
ঝালকাঠি-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের একজন মনিরুজ্জামান মনির৷ তিনি সাবেক ছাত্রনেতা এবং আওয়ামী লীগ নেতা৷ তাঁর মতে, এবার প্রধানত চারটি কারণে আওয়ামী লীগ থেকে মনোয়ানপ্রত্যাশী বেশি৷ তাঁর মতে কারণগুলো হলো, ‘‘কেউ কেউ এই মনোনয়নপত্র কেনার মাধ্যমে আগামী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চান৷ তরুণ এবং সাবেক ছাত্র নেতারা আগে তেমন মনোনয়ন পাননি৷ এবার তাঁরা চান৷ নারীদের অনেকে মনোনয়ন ফর্ম কিনেছেন, তাঁদের এর মাধ্যমে সংরক্ষিত কোটায় এমপি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চান৷ আর সবশেষ কারণ হলো, আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী এমপি যাঁরা আছেন, তাঁদের আওয়ামী লীগবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অনিয়মে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষোভ৷”
তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা মনোনয়ন ফর্ম কিনেছেন, তাঁদের মধ্যে বড় একটি অংশ আছে যাঁরা মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান৷ নেত্রী গণভবনে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের মনোনয়ন দেয়া হবে না৷ এই হিসেবে সরাসরি প্রায় দুই হাজারের মতো মনোনয়ন ফর্ম বিবেচনায় আসবে না৷”
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবার মনোনয়ন চূড়ান্ত করার পর যাতে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষেভের সৃষ্টি না হয়, সেই দিকেই সতর্কতা অবলম্বন করছেন৷ যাতে কেউ ক্ষুব্ধ হলেও তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে না পারে, সেজন্য কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা করা হচ্ছে৷ বৃহস্পতিবার ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এসব নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ সেখানে এ পর্যন্ত করা পাঁচটি জরিপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে৷
এ সব জরিপের ওপর ভিত্তি করেই ২৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ৷ এর আগে ১৪ দলীয় জোট এবং জাতীয় পার্টি ও বিকল্পধারার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত হবে৷ ১৪ দলীয় জোটের সবাই নৌকা প্রতীকে এবং জাতীয় পার্টি ও যুক্তফ্রন্ট নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করবে৷ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘‘দেশি-বিদেশি ৫-৬টি জরিপ আছে, তার ভিত্তিতে আমরা প্রার্থী মনোনয়ন দেবো৷ সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে৷ জোটের শরিকদের জন্য কিছু আসন ছেড়ে দেয়া হবে৷”
এর আগে তিনি জোটের শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ৭০টি আসন ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন৷
-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন