আম কুড়িয়ে খড়ের গাদার নীচে লুকিয়ে রাখতাম

গ্রামে ঝড় এলেই আম বাগানে ছুট। আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগীতা ছিল পুরস্কার পাওয়ার জন্য যেভাবে দৌড় দেয়া হয়, সেরকম। শৈশবে আম কুড়ানোর স্মৃতি কম-বেশি সকলের ই থাকে। তবে আমর বেলায় একটু ভিন্ন। কারণ আম গাছটি যদি নিজের হয় তাহলে ব্যাপারটি হয় এক রকম, আর গাছটি যদি হয় অন্যের তাহলে হয় ভিন্ন রকম।

আমরা জানি, আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাল্গুনে। কিন্তু চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকেই আমাদের বাড়ির দক্ষিন পাশের ছাড়াবাড়িতে (পরিত্যক্ত বাড়ি) গিয়ে আম কুড়াতাম। আম বাগানের পাশেই পিছলা গাছের আঠা দিয়ে নিজে বানানো ঘুড়ি উড়াতাম। যখন একটু জোরে বাতাস বইতো তখনই ছোট ভাই আমিনের হাতে নাটাই দিয়ে এক দৌড়ে চলে যেতাম আম গাছের কাছে। তখন শিল পড়া আমগুলো একটু নরম নরম হলে ই সেগুলো হাফপ্যান্টে দুটো ঘষা দিয়ে লবন –মরিচ দিয়ে সাবার করতাম। এছাড়া স্কুলে যাওয়ার সময় আকামত আলী জ্যাঠার সড়কের পাশের টক গাছ গুলো থেকে আম খেতাম। তবে এগুলো ছিল আম কুড়ানোর প্যাকটিস, মূল প্রতিযোগীতা হতো বাড়িতে।

শতবর্ষী আম গাছ থেকে একটি আম পড়তে না পড়তে ই আমরা সেটি লুফে নেয়ার জন্য দৌড় দিতাম। কেউ একটু লেট করলেই মিস। কেননা প্রতিযাগী এক-দুজন নয় কয়েকজন। ব্যাপারটি হলো এই, আম গাছটি ছিল যৌথ। আমার বাবা-কাকারা যখন বাড়ি ভাগাভাগি করে তখন সালিশদারা বল্ল, বৃটিশ আমলের এই আম গাছটি তোমাদের সবার, সবাই মিলে- মিশে আম খাবে ,কিন্তু কেউ এর ডালা কাটতে পারবে না। তাই আমাদের পরিবার থেকে আমি, মনির ভাই, জ্যাঠাত ভাই হামিদ, ভাগিনা মাসুদ, ফুফাত ভাই রহিম ভাগনী ফেরদৌসী আম কুড়ানোর অলিখিত প্রতিযোগিতায় নামতাম। আবার আম গাছ থেকে থেকে বাতাসে টুপ করে কোন আম যদি পড়ত পুকুরে ,তাহলে তা কখন ভেসে উঠবে তার অপেক্ষায় থাকতাম। ভাসার পর আমি বড় লাঠি খুঁজতে খুঁজতে রহিম উদ্দিন ঝটপট লুঙ্গি খুলে পুকুরে নেমে গিয়ে সেটি হস্তগত করতো। সেই স্বর্গীয় দিনগুলো কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? আম কুড়ানোর পাশাপাশি আমরা জামও কুড়াতাম। এছাড়া বড়ুই পাকলে নিজের বাড়িতে বড়ই গাছ থাকলেও একটু ভিন্ন স্বাদের বড়ই খাওয়ার জন্য যেতাম মিঠা জ্যাঠার গাছের নীচে মিঠা জ্যাঠার একটি সুন্দর নাম ছিল, আমরা কেউ তার নাম জানতাম না। তিনি খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতেন তাই আমরা সবাই মিঠা জ্যাঠা বলে ডাকতোম। কেউ কেউ মিঠা দাদা বলেও ডাকতেন। সে সময় সম্বোধন সহ মুরুব্বীদের নাম ধরে ডাকা বেয়াদবী ছিল। আমরা ছোট বলে নয়, ওনার সমবয়সীরাও তাকে নাম ধরে ডাকতেন না। শুধু তার কথা ই বা বলি কেন আমার মাকে সবাই ডাকতো লেকতের মা, জ্যাঠিমাকে ডাকতো মনুর মা, যদিও তাদের আরও ছেলে মেয়ে ছিল তবুও বড় সন্তানের নামেই ডাকতো।

এ তো ছিল মহিলাদের ব্যাপারে কথা, আর পুরুষদের ব্যাপারে যে যে পেশায় কাজ করতেন, তা সে সে পেশার প্রতিনিধি হিসাবে নাম পেতো। এছাড়া কেউ যোগ্যতা ভিত্তিক কিছু বিশেষণে বিশেষায়িত হতেন। আর এটি ছিল কথা-বা চাল-চলনের উপর। এ হিসাবে আমাদের মিঠা জ্যাঠা মিঠা মিঠা কথা বলার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এছাড়া নলপুকরিয়ার আব্দুল হাকিম কে বিভিন্ন বাড়ির লোকেরা দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন গল্প শোনার জন্য। চাঁদনী রাতে উঠানে মোস্তাক গাছের পাটিতে বসে বাড়ির ছেলে-বউ-ঝি সবাই মিলে রাত পার করে দিত। যাক, বলছিলাম মিঠা জ্যাটার বাড়ির টক বড়ই কুড়ানোর কথা। প্রচন্ড বাতাসেও যখন কোন বড়ই পড়ছেনা, তখন আমাদের মধ্যে কে যেন ঢিল মেরেছিল। তখন ই একটি মহিলা এসে আমাদেরকে বকা-বকি শুরু করল।প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো কে ঢিল মেরেছে ? আমরা যদিও জানতাম তবুও কেউ সঠিক নাম বলল না। আমি বল্লাম ও ,সে বল ও ,আমি নাতো সে, অবার সেও বল্ল ,আমি নাতো মোটা ছেলেটা ।আরেকজন বলল যে ঢিল মেরেছে সে চলে গেছে। এভাবে বলাতে মনে হয় দোষটা হালকা হয়ে গেছে। তখন আমাদেরকে ঢালাওভাবে বকাবকি করলেও জসিম উদ্দীনকে বলল, মনা তুমি এসেছ ? ওরা চলে যাক , তুমি খাও-খাও লবন-মরিচ দিয়ে খাও। তারপর থেকে ঔ আন্টিকে দেখলেই আমরা ক্ষেপাতাম- খাও,খাও,খাও লবন মরিচ দিয়ে খাও।
তবে এখনও গ্রামে গেলে দেখা মেলে এমন দৃশ্য। কাঁচা আম কুড়িয়ে এনে সে আম ছুলে কচি করে ঝাল লবন মেখে খাওয়া কী যে আনন্দ সেটা মনে হলেই জিভে জল চলে আসে। এমনই দেখা মেলে এলাহাবাদ গ্রামে।

লেখক:
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,
মানবাধিকার কর্মী,কিটো ক্যম্পেইনার ও কলামিস্ট