একঘরে কাতার, বাংলাদেশে প্রভাব কতটা?

সন্ত্রাসবাদীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগে কাতারের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে সৌদি আরব, মিসরসহ ছয় দেশ। কাতারকে এভাবে একঘরে করার ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ক্ষতির পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে।

সৌদি আরব বাংলাদেশের বড় শ্রমবাজার। কাতারেও বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক রয়েছেন। সরকারি হিসাবে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট জনশক্তি রপ্তানির ২২ শতাংশের গন্তব্যস্থল ছিল কাতার। এ অবস্থায় কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আমাদের দেশে কতটা প্রভাব পড়বে?

বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ূন কবির মনে করেন আপাতত কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে ভবিষ্যতে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে তিনি দুটি বিষয় তুলে ধরেন। প্রথমত, উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে এই উত্তেজনা দীর্ঘমেয়াদি হলে আমাদের দেশের শ্রমিকদের ওপর প্রভাব পড়বে। সৌদি আরব ও কাতারে নির্মাণ খাতে আমাদের অনেক শ্রমিক কাজ করেন। এখন কাতারে যদি নির্মাণ ব্যয় বাড়ে বা বিনিয়োগ কমে, স্বভাবতই শ্রমবাজারে তার প্রভাব পড়বে। আর এতে বাংলাদেশে প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে ঘিরে বহু নির্মাণকাজ হচ্ছে কাতারে। আমাদের শ্রমিকেরাও যাচ্ছেন সেখানে। সেই কাজে স্থবিরতা আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, এখনো এটা বলা যাচ্ছে না কাতারের ওপর সৌদি আরব আরও চাপ বাড়াবে কি না। যদি বাড়াতে চায় তাহলে ইসলামিক সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সমর্থনও তাঁরা চাইতে পারে। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সংঘাতের মধ্যে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরের কিছুদিন পর সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে কাতারকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত জানাল প্রতিবেশী দেশগুলো। এ ছাড়া ইরানের কথিত প্রশংসাকে ঘিরে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে বলে মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত। তাই এ জটিলতা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

তবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এখনই ভয়ের কিছু নেই বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রাখতে হবে। পরবর্তী সময়ে আমরা কোনদিকে যাব তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

এ তো গেল বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ফলে কাতার কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। রয়টার্সের বিশ্লেষণ বলছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলেও বিপুল সম্পদ থাকায় সংকট কাটাতে পারবে কাতার। নতুন সম্প্রসারিত বন্দর সুবিধার মাধ্যমে দেশটির তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানি চলবে, খাদ্য সমুদ্রপথে আমদানি করতে পারবে।

তবে নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সহজ নয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কাতারের পুঁজিবাজারে সূচকের ৭ শতাংশ দরপতন হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা কয়েকটি ক্ষতিকর প্রভাবের দিকের কথা বলেছেন।

১. ক্ষতির মুখে পড়বে দ্রুত বর্ধনশীল কোম্পানি কাতার এয়ারওয়েজ এবং দেশটির পর্যটন খাত।

২. ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ঘিরে অবকাঠামো উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক মিলিয়ে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ রয়েছে কাতার সরকারের। ইতিমধ্যেই দেশটির বন্ডের দাম কমতে করতে শুরু করেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে ঋণ নেওয়া আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে কাতারের জন্য। তবে বন্ডের দাম কমলে বিপাকে শুধু কাতার নয়, উপসাগরীয় ছয়টি দেশেও তার প্রভাব পড়বে।

৩. ২০১৫ সালে ১ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলারের খাদ্য আমদানি করে কাতার। এর মধ্যে প্রায় ৩১ কোটি ডলারের খাদ্য আমদানি করা হয় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। এসব খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে বেশির ভাগই দুগ্ধজাত পণ্য। এখন দোহারকে এসব আমদানির জন্য আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪. নির্মাণকাজের ব্যয় বাড়বে কাতারে। অ্যালুমিনিয়াম ও বাড়ি তৈরির অনেক সরঞ্জামই এখন স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা সম্ভব হবে না। এতে মূল্যস্ফীতিতেও চাপ পড়বে।