এত কম আসন, এত কম ভোট কেন বিএনপির?


এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসন পেয়েছে মাত্র ৫টি৷ আর তাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিবেচনা করলে সব মিলিয়ে মাত্র ৭টি৷ জামায়াত কোনো আসনই পায়নি৷ বিএনপি আর তার জোটের ভোটে এত ব্যর্থ হওয়ার কারণ কী?


২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি, বরং সেই নির্বাচন প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে৷ তার আগে সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি৷ ওই নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি আসন পায়৷ সেবার তাদের ভোটের শতকরা হার ছিল ৩৩ দশমিক ২৷ অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিল৷ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল শতকরা ৪৯ ভাগ ভোট৷ সেবার জামায়াত পেয়েছিল ২টি আসন আর ভোট পেয়েছিল ৪ দশমিক ৬ ভাগ৷ ওই নির্বাচনটি হয়েছিল তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে৷ ১০ বছর আগের সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ২৭ টি আসন আর ভোট পেয়েছিল শতকরা ৭ ভাগ৷ অন্যান্য দলের ভোটের হার শতকরা এক ভাগেরও কম৷

তবে তার আগে, অর্থাৎ ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল৷ তখন তাদের শতকরা ভোটের হার ছিল ৪১ দশমিক ৪ ভাগ৷ সেবার দুরবস্থা হয়েছিল আওয়ামী লীগের৷ তারা পেয়েছিল ৬২টি আসন আর ভোট পেয়েছিল শতকরা ৪০ দশমিক ০২ ভাগ৷ নির্বাচনে বিএনপি ভালো করলে, তার প্রভাব জামায়াতের ওপরও পড়ে৷ তাই সেই নির্বাচনে জামায়াত পেয়েছিল ১৭টি আসন আর একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া দলটি ভোট পেয়েছিল ৪ দশমিক ২৮ ভাগ৷ জাতীয় পার্টি ১৪টি আসন পেলেও তাদের ভোটের হার ছিল ৭ দশমিক ২২ ভাগ৷

আর ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়েও একবার সরকার গঠন করেছিল৷ সেবারও আওয়ামী লীগ বেশি ভালো করেনি৷ ৮৮টি আসন পেয়েছিল মৃক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটি৷ আসন কম পেলেও, শতকরা হার ছিল হারে ভোট কিন্তু দু’দলের প্রায় একইরকম ছিল৷ বিএনপি পেয়েছিল ৩০ দশমিক ৮ এবং আওয়ামী লীগ ৩০ দশমিক ১ ভাগ৷

বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, আওয়মী লীগের ও বিএনপি’র আলাদা আলাদা ভোট ব্যাংক আছে৷ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সেই ভোট ব্যাংকে তেমন প্রভাব পড়ে না৷ জাতীয় পার্টির পরে জামায়াত কোনো জোটে গেলে নির্বাচনে তার একটা প্রভাব পড়ে৷ তবে মূল ভুমিকা পালন করে প্রায় ১৫ ভাগ ফ্লোটিং ভোটার এবং তরুণ ভোটাররা৷ সাধারণভাবে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংকে ৩৮ থেকে ৪০ এবং বিএনপি’র ভোট ব্যাংকে ৩৪ থেকে ৩৬ ভাগ ভোট রয়েছে৷ এবং এই ভোটটা মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী৷ এবং এটা নতুন কিছুও নয়৷ ১৯৭০ সালের সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনেও প্রায় ২৬ ভাগ ভোট আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ছিল৷

কিন্তু এবারের নির্বাচনে অতীতের সব হিসাব উল্টে গেছে৷ বিএনপি আসন পেয়েছে মাত্র ৫টি৷ এত কম আসন বিএনপি অতীতে কখনোই পায়নি৷ তাছাড়া এবার ৪-৫ ভাগের বেশি ভোটও বোধহয় পায়নি তারা৷ তবে ভোটের পুরো হিসাব-নিকাশ হলে প্রকৃত হিসেবটা জানা যাবে৷

‘৯০-এর পর এবারই প্রথম বিএনপি’র প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামি কোনো আসন পায়নি৷ তবে বিএনপির প্রাধান্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দল গণফোরাম ২টি আসন পেয়েছে৷ এটাও একটা রেকর্ড৷ কারণ ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরামের কেউই অতীতে জাতীয় নির্বাচনে পাস করেনি৷

এবারের নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়ার কথা জনিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা৷

আওয়ামী লীগ বা তার জোটসঙ্গীদের প্রার্থীদের সঙ্গে বিএনপি বা তার জোটের যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ভোটের ব্যাবধান বিপুল৷অতীতে সাধারণভাবে ভোটের এত ব্যবধান আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে দেখা যায়নি৷

যেমন, নোয়াখালী-৫ আসনে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের ভোট পেয়েছেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৪টি আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি’র মওদুদ আহমদ পেয়েছেন মাত্র ১০ হাজার ৯৭০ ভোট৷ মওদুদ আহমদকে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৭৪ ভোটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছেন ওবায়দুল কাদের৷

২০১৪ সালের নির্বাচনে ওবায়দুল জিতেছিলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়৷ ২০০৮ সালেও মওদুদ আহমদে পরাজিত করেছিলেন তিনি৷ তবে সেবার ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ১২ হাজার ৫৭৫টি৷ ২০০১ সালের নির্বাচনে ওবায়দুল কাদের হেরেছিলেন মওদুদের কাছে৷ সেবার তিনি ভোট পান ৪৫ হাজার ৯৭২টি৷ সেবার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে মওদুদ হারান ওবায়দুল কাদেরকে৷ পেয়েছিলেন ৮৪ হাজার ৫৭৮ ভোট৷ তবে ২০০৮ সালে তিনি হেরে যান ওবায়দুল কাদেরের কাছে৷ তবে ভোট পেয়েছিলেন ১ লাখ ১১ হাজার ২০৪টি৷ সেই মওদুদ আহমদ এবার পেলেন মাত্র ১০, ৯৭০ ভোট৷ এরকম উদাহরণ এবার অনেক৷ বিএনপির খুব কম প্রার্থীই এবার ৩০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছেন৷

সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সাফল্য আর বিএনপির ভরাডুবি প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এখানে ভোট ব্যাংকের যে হিসাব আছে, তাতে এটা অবিশ্বাস্য৷ আমাদের অভিজ্ঞতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়৷ অতীতে আমরা এরকম আর দোখিনি৷ এটা আমাদের হিসেবের সাথে মেলে না৷” কেন এরকম হলো– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদের অতীত অভিজজ্ঞতার সাথে মেলে না এইটুকুই৷ এর বাইরে আমি কিছু বলতে চাই না৷”

তবে দেশের বড় দুটি দলের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ফলাফলের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটা কারণ হলো, আওয়ামী লীগের তোপের মুখে বিএনপি টিকতে পারেনি৷ আমি রাজনৈতিক তোপের কথা বলছি৷ আর গত দশ বছরে এই দলটি সাধারণ মানুষের কাছে দাঁড়াতে পারেনি৷ এটা ওনাদের ব্যর্থতা, না জনগণের ‘টেস্ট’ চেঞ্জ হয়ে গেছে, বলতে পারি না৷ তারা আশা করেছিল নীরব ভোটবিপ্লব হবে৷ তা হয়নি৷ তবে একটা কথা সত্যের খাতিরে বলতেই হবে, আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থাটা এখনো শতভাগ সুষ্ঠু হয়নি, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে শতভাগ অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে পারে৷ এইসব বিষয় আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে৷ আসন সংখ্যা বিএনপি’র তলানিতে থেকেছে৷ কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে আছে, তা বুঝতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘বিএনপি ভোট রিগিং নিয়ে যে অভিযোগ করছে সেটা নিয়ে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে৷ কারণ বিএনপি যে মাত্রায় বলছে, সে মাত্রায় এটা হয়নি৷ কারণ, আমি এবং আমার কলিগরা ভোট দিয়েছি৷ অনেকেই দিয়েছে৷ আবার কিছু অভিযোগও আছে৷ কিন্তু এটা না হলে যে বিএনপি’র পক্ষে ভোটবিপ্লব হতো তা আমি মনে করি না৷ আর পর্যবেক্ষরাও তো ছিলেন৷ তাঁরা কিন্তু অতটা ক্রিটিক্যাল নন৷”

বিএনপির অভিযোগ এবং দাবি

এদিকে সোমবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, ‘‘পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সুপরিকল্পিত একটি নির্বাচন হয়েছে, যার ফলে নির্বাচনে এই ধরনের অবিশ্বাস্য ফলাফল দেখা যাচ্ছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানাই৷ আমরা এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করছি এবং অবিলম্বে নির্দলীয় সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন দিতে হবে৷”

তিনি অরো বলেন, ‘‘বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে প্রশাসন, ল অ্যান্ড অর্ডার যাঁরা দেখেন, তাঁদের এবং গোয়েন্দাদের যোগসাজশে নজিরবিহীন এই নিবাচন করা হয়েছে৷ অতীতে কখনো এমন নির্বাচন দেখিনি৷ পুরো নিবাচনের আগে থেকে ত্রাসের সৃষ্টি করা হয়েছে৷ জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কময় নির্বাচন৷”

আওয়ামী লীগের জবাব

তবে দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেছেন, ‘‘এই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ একটি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষদাঁত চিরতরে ভেঙে দিয়েছে৷ জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধী অপশক্তির হাত গুঁড়িয়ে দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে৷ বাংলাদেশের মানুষ ন্যায়ের পথে আছে, সত্যের পথে আছে, স্বাধীনতার পক্ষে আছে, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে আছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে৷”

তিনি বিএনপি, তথা ঐক্যফ্রন্টের ভোট কারচুপির অভিযোগের জবাবে বলেন, ‘‘গণরায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট৷ তাদের দাবি অযৌক্তিক৷ তাদের এই দাবি গণবিরোধী৷”

নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য

সোমবার নির্বাচন পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘‘নির্বাচন নিয়ে আমরা অতৃপ্ত নই৷ পুরো কমিশনই সন্তুষ্ট৷ আর কমিশনের কেউ অসন্তুষ্ট, এমনটি কেউই আমাকে বলেননি৷”

জাতীয় ঐক্যফন্টের নির্বাচন বাতিলের দাবির বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘‘অনিয়মের অভিযোগটি সম্পূর্ণ অসত্য কথা৷ নতুনভাবে নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নাই৷”

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ঢাকার কয়েকটি কেন্দ্রে ‘সংঘটিত অনিয়ম’ তুলে ধরে বিষয়টি কমিশনের কাছে ‘লজ্জাজনক’ কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘লজ্জা পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটে নাই৷”