কক্সবাজারে এবারও আয়োজন থাকছে না থার্টিফাস্ট উদযাপনে

রোববারের সূর্যটি পশ্চিমাকাশে ডুবে গেলেই শুরু হবে নতুন বছরের সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষা। সূর্য ডোবার এ রাতেই পৃথিবীর হালখাতা থেকে স্মৃতি হবে ২০২৩ সাল নামের আরও একটি বছর। সোমবারের সূর্যের সঙ্গে শুরু হবে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের পথচলা।

বিদায়-বেদনার মাঝেও ৩৬৫ দিনের সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব পেছনে ফেলে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় ৩১ ডিসেম্বর রাতে ২০২৪ সালকে স্বাগত জানিয়ে পালন করা হবে থার্টিফাস্ট নাইট। তবে কক্সবাজার সৈকত বা পর্যটন জোনের খোলা কোনো মাঠে এবারও কোনো আয়োজন নেই।

বিগত দেড় দশক ধরে প্রতিবছর থার্টিফাস্ট নাইট উপলক্ষে পর্যটন নগরী কক্সবাজার লোকারণ্য হয়ে ওঠে। ১৫ বছর ধরে চলা এমন চিত্র গত সাত বছর ধরে বন্ধ। তবুও থার্টিফাস্ট এবং বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে কক্সবাজার সৈকত ও আশপাশের পর্যটন এলাকায় অতিথি ও স্থানীয় মিলিয়ে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম হবে এমনটি প্রত্যাশা পর্যটন সংশ্লিষ্ট ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির।

ট্যুরস অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, গত নব্বই দশকের শেষ থেকে থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপনে বেসরকারি টেলিভিশন কিংবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি সৈকতে উন্মুক্ত বিনোদন আয়োজন করে বর্ষবরণ জমিয়েছে। তারকা হোটেলগুলো আয়োজন করতো ইনডোর প্রোগ্রাম। যেখানে বহিরাগতরাও অংশ নিতে পারতো। কিন্তু ২০১৭ সালে সঙ্গে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গার আগমণ ঘটে।

এরপর বাংলাদেশে পূর্ব থেকে অবস্থান করা আরও তিন-চার লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থান করানো হচ্ছে। সেই থেকে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় ২০১৭ সাল থেকে থার্টিফাস্ট নাইট উপলক্ষে সৈকত তীরে উন্মুক্ত বা বাউন্ডারি ভুক্ত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর ২০১৯ সালে করোনা মহামারির পর পুরো পর্যটন নগরীই বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে থার্টিফার্স্ট নাইটের সেই জমজমাট আয়োজন আর হচ্ছে না কক্সবাজারে।

টুয়াকের সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, থার্টিফার্স্টে উন্মুক্ত কোনো আয়োজন না থাকায় এবারের থার্টিফাস্ট নাইট বা নতুন বর্ষবরণকেও ‘প্রাণহীন’ বলা চলে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারও বিচে ওপেন অনুষ্ঠান বন্ধ। তবে পর্যটকরা চাইলে রাত ১-২টা পর্যন্ত বিচে ঘুরতে পারবেন। এ সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে থাকবে। কিন্তু রাত দশটার পর হোটেলের সব বার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে শহরের অভ্যন্তরে যানজট কমাতেও।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা জানান, থার্টিফাস্ট নাইট উৎসবের আগেই বড়দিন ও শীতকালীন ছুটি উপলক্ষে পর্যটক পদচারণা বেড়েছে কক্সবাজারে। পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছেন সমুদ্র সৈকত, ইনানী, হিমছড়ি, রামুর বৌদ্ধপল্লী, চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, মহেশখালীর আদিনাথসহ পুরো কক্সবাজারের পর্যটন স্পটে। সমানে যাচ্ছেন সেন্টমার্টিনেও। অনেক পর্যটক সেন্টমার্টিনে অবস্থান করে নতুন বছরকে বরণ করবেন।

কক্সবাজার হোটেল-গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, মৌসুমের এ সময়টায় কক্সবাজারে পর্যটক সমাগম বাড়তি থাকে। কক্সবাজারে আসা পর্যটকদের সিংহভাগই এক বা দুদিনের ট্যুরে সেন্টমার্টিন যান। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আগামী বছরের শুরুতে। তাই শংকায় অনেকে বেড়াতে বের হচ্ছেন না। ফলে অন্য বছরের চেয়ে পর্যটক আগমণ কম। এরপরও ইংরেজি নতুন বছর ২০২৪ কে স্বাগত জানাতে পর্যটকসহ কয়েক লাখ মানুষের মিলন মেলা হবে আশা করা যায়। এরইমধ্যে অধিকাংশ রুম বুকিং হয়েছে।

কক্সবাজার জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতা রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, বেড়াতে আসা পর্যটকদের অভিযোগ কক্সবাজারে শিশুদের বিনোদন ও রাতের বেলা উপভোগ্য কিছু না থাকায় দু’একদিন পর ফিরে যেতে হয়। তবে গলফ্ মাঠে চলমান শিল্প ও বাণিজ্য মেলা রাতের পর্যটনে বিনোদনের খোরাক যোগাচ্ছে।

নরসিংদীর মোহাম্মদ আলী দম্পতি বলেন, পরিবারের সবার ইচ্ছা ছিল, সৈকতের বালুচরে দাঁড়িয়ে রাত ১২টা ১ মিনিটে পুরোনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করবো। এ সময় আতশবাজির ঝলকানি এবং ফানুসের আলোয় ঝলমল হতো অন্ধকার আকাশ। ছয় বছর আগে কয়েক লাখ মানুষের উপস্থিতিতে থার্টি-ফাস্টনাইটের এমন উৎসব জমকালো ও উপভোগ্য ছিল। কিন্তু বিগত ছয়টি বছরের মতো এবারো কোনো আয়োজন নেই জেনে আগাম বেড়িয়ে চলে যাচ্ছি।

কক্সবাজার চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গা বিষয়টি মানবিক বিপর্যয়। এটি কক্সবাজারের সৌন্দর্য্যকে ম্লান করতে পারেনি। তাই থার্টিফাস্ট নাইটে সৈকতে উন্মুক্ত অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত নয়। সবাই মিলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থার্টিফাস্ট নাইটের অনুষ্ঠান করা গেলে পর্যটনের বিভিন্ন সেক্টরে কয়েকশো কোটি টাকার বাণিজ্য হতো।

টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আপেল মাহমুদ বলেন, কক্সবাজারের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সৈকতের কোথাও আতশবাজি, পটকা ফোটানোসহ গান-বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা ব্যান্ডসংগীতের আয়োজন করতে পারবে না কেউ। তবে স্বাভাবিক অবস্থায় বালুচরে দাঁড়িয়ে সমুদ্র উপভোগ করা যাবে। বিধিনিষেধ পালনে টুরিস্ট পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে পোশাক পরিহিত পুলিশের সঙ্গে সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে দায়িত্ব পালন করবে। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো রোধে সন্দেহভাজনদের ব্রিথিং টেস্টের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিভিন্ন সড়কে চেকপোস্ট স্থাপন করে যতোটা সম্ভব চলবে তল্লাশি।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সরকারি নির্দেশনার প্রেক্ষিতে সৈকতের উন্মুক্ত স্থানে থার্টিফাস্ট নাইট উপলক্ষে কনসার্ট, গান বাজনাসহ সব ধরনের আয়োজন এবারও বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ চাইলে তাদের অতিথিদের জন্য নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করতে পারে। সার্বক্ষণিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পর্যটন এলাকায় টহলে থাকবে।