কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস : নিয়মে ভোগান্তি, দালালে প্রশান্তি!

দালাল চক্রের হাত থেকে কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসটির মুক্তি কোনভাবেই মিলছে না। দিন দিন এই অফিসটি যেন দালালদের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। সেবাগ্রহীতারা দালালদের মাধ্যম ছাড়া এই অফিসে গেলে তাদের ভাগ্যে জোটে শুধুই দুর্ভোগ আর ভোগান্তি। অফিসটির কার্যক্রম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন নিয়ম মানলেই ভোগান্তি আর দালাল ধরলেই প্রশান্তি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেবাগ্রহীতা এবং অফিসের লোকজনের কাছে দালালদের মাধ্যমটি ‘চেইন’ নামে পরিচিত। অনেক সেবা প্রত্যাশী জানায়, দালালের মাধ্যম ছাড়া আবেদন জমা দিলে ১৫ দিনের পাসপোর্ট অনেক সময় ৬ মাসেও পাওয়া যায় না। এতে অনেকের সঠিক সময়ে বিদেশ যাওয়া বাতিল হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অথচ দালালের ‘চেইনে’ গেলে সঠিক সময়ের আগেও মিলছে পাসপোর্ট।

সরেজমিনে গিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পাসপোর্ট অফিসটিতে দালাল ছাড়া কোন কাজ করতে গেলে সেবাগ্রহীতাদের পদে পদে ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হতে হয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওই অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে পাসপোর্ট তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটি এখন দালালদের হাতে। তাদের ‘চেইন’ ছাড়া পাসপোর্ট করতে গেলে পড়তে হয় হয়রানিতে। শুরু হয় নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতাও। বাধ্য হয়ে সেবা প্রত্যাশীরা এসব ভোগান্তির অভিযোগ নিয়ে যাচ্ছেন উপ-পরিচালকের কাছে। সেখানেও তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে নগরীর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে অন্তত ১০ জন দালালকে আটক করেছিল র‌্যাব। এসব অভিযানে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬ শতাধিক পাসপোর্ট, বিভিন্ন সিল, ভুয়া সনদ, ভুয়া সার্টিফিকেটসহ অনেক কাগজপত্র। সে সময় আটককৃতরা অবৈধপথে পাসপোর্ট তৈরির সঙ্গে কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা সফিজুল ইসলাম, মিজানসহ তিনজনের জড়িত থাকার কথা র‌্যাবকে জানিয়েছে। এরপর তাদের এই অফিস থেকে বদলী করা হয়। এছাড়া ওই ঘটনায় পর বদলি করা হয় ওই সময়ের অফিস প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থাকা সহকারী পরিচালক শামীম আহমেদকেও। কিন্তু এখনো কমেনি দালালের দৌরাত্ম্য।

পাসপোর্ট অফিস ও অন্যান্য সূত্র জানায়, সরকারি নিয়মে ২১ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে খরচ হয় ৩ হাজার ৪৫০ টাকা, আর জরুরি প্রয়োজনে ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে খরচ হয় ৬ হাজার ৯শ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। দালালরা ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে পাসপোর্টের জন্য সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে নিচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, আর ২১ থেকে ২৫ দিনের জন্য নিচ্ছেন ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা। ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও দ্বিগুণে বেশি টাকা নিচ্ছেন দালালরা।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের মূল ফটকে দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মাসের পর মাস ঘুরেও পাসপোর্ট না পাওয়ার কথা বলছেন এক ভুক্তভোগী। এ সময় ওই পুলিশ সদস্যও বলে উঠেন- আমি নিজেও পাসপোর্ট করেছি দালালের মাধ্যমে। দালালের মাধ্যমে না গেলে আমাদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়।

জেলার বরুড়া উপজেলার বাসিন্দা আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি অনলাইনে ই-পাসপোর্টের আবেদন করে জমা দিতে গেলে তারা আমার আবেদন জমা নিতে চায়নি। এটা-ওটা ভুল হয়েছে বলে আমাকে সারাদিন ঘুরিয়েছে। পরে অফিসের এক লোক বলল ‘চেইনে’ আসলে এই সমস্যা হতো না। এরপর আমি উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতেও কয়েক ঘণ্টা লেগেছে। শেষ পর্যন্ত সারাদিন ঘুরে জমা দিয়েছি, তবে সঠিক সময়ে পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে চিন্তায় রয়েছি।

জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলাে উপজেলার বাসিন্দা সাকিবুল ইসলাম রনি বলেন, দালাল ছাড়া গত বছরের ৯ জানুয়ারি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। পাসপোর্ট দেওয়ার কথা ছিলো ওই বছরের ৩০ জানুয়ারি। কিন্তু তিনি সেই পাসপোর্ট পেয়েছেন এক বছর পর চলতি বছরের ৩ মার্চ। সঠিক সময়ে পাসপোর্ট না পাওয়াতে তাঁর বিদেশ যাওয়া বাতিল হয়েছে।

চাঁদপুরের শাহরাস্তি থেকে আসা মামুন মিয়া বলেন, হয়রানি আর বিদেশ যাত্রা বাতিল হওয়ার ভয়ে ৩ হাজার ৪৫০ টাকার পাসপোর্ট দালালের মাধ্যমে ৯ হাজার দিয়ে করিয়েছি। দালাল সময় নিয়েছিলো এক মাস। কিন্তু তিনি ২৬ দিনের মধ্যেই পাসপোর্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে। এই অফিসের দালাল ছাড়া এখন কোন কাজই হয় না।

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্টে অফিসের উপ-পরিচালক মো.নুরুল হুদা বলেন, প্রিন্টিং সমস্যার কারণে অনেক সময় পাসপোর্ট আসতে দেরি হয়। এছাড়া আবেদনে তথ্যগুলো ভুল, পুলিশ প্রতিবেদন দেরিতে আসাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণেও মানুষ সঠিক সময়ে পাসপোর্ট পায় না। তবে যেকোন সেবাগ্রহীতা আমার কাছে আসলে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি দ্রুত সমস্যা সমাধান করার জন্য।

দালাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর থেকেই সকল কিছু নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে মানুষ এখন ভালো সেবা পাচ্ছে, সরকারি ফি জমা দিয়ে পাসপোর্ট পাচ্ছে। এরপরও দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা এসব চক্রকে একেবারে শেষ করা যায়নি। আমরা চেষ্টা করছি কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে শতভাগ দালাল মুক্ত করতে।