ক্রিকেটকে যেভাবে বদলে দিয়েছে কেরি প্যাকারের ‘বিদ্রোহী’ সিরিজ

এখন থেকে ৪০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার এক টিভিচ্যানেল মালিক কেরি প্যাকার – ক্রিকেটের সম্প্রচার স্বত্ব নিয়ে বিবাদের কারণে নিজেই সেরা খেলোয়াড়দের কিনে নিয়ে চালু করেছিলেন এক বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ – যার নাম ছিল ওয়ার্ল্ঢ সিরিজ ক্রিকেট।

সেই ক্রিকেট খেলতে প্রথম যারা নাম লিখিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাইকেই নিষিদ্ধ করেছিল তাদের দেশের ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেটে সেই প্রথম দেখা গেল দিনরাতের ক্রিকেট, রঙীন পোশাক, সাদা বল, কালো সাইটস্ক্রিন, ব্যাটসম্যানের হেলমেট, আর ১৩টি ক্যামেরা দিয়ে জমকালো টিভি সম্প্রচার ।

মাত্র দু’বছর – ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত – চলেছিল ওই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট। কিন্তু ক্রিকেট খেলাকেও যে বিপণন করা যায় – আর তা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করা যায় – তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল এই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট দিয়েই। খবর বিবিসির।

“আজকের যুগে ক্রিকেট যে চেহারা নিয়েছে – তার অনেক কিছুরই শুরু সেই কেরি প্যাকারের বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই” – বিবিসির এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন প্যাট মার্ফি, যিনি রিপোর্টার হিসেবে সেই প্রথম ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের খবর দিতেন। কেরি প্যাকারের সিরিজ নিয়ে একটি বই লিখেছেন অস্ট্রেলিয়ান লেখক গিডিয়ন হেইগ।

গিডিয়ন হেইগ বলেন, “এ যুগে আপনি ক্রিকেট দুনিয়ার যে দিকেই তাকাবেন – সেখানেই দেখবেন কেরি প্যাকারের সিরিজের প্রভাব। দিনরাতের ক্রিকেট ম্যাচ, সাদা বল, রঙিন পোশাক , হেলমেট, ফিল্ড রেস্ট্রিকশন, দলের মধ্যে ফাস্ট বোলারএর প্রাধান্য, আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, উন্নত মানের ফিল্ডিং, ‘ড্রপ-ইন’ পিচ বা অন্য জায়গায় তৈরি করে মাঠে বসিয়ে দেয়া উইকেট – এগুলো সবই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের আবিষ্কার, এবং সবই ওই দুই বছরের মধ্যে চালু করা হয়েছিল। এর ফলেই ১৯৮০র দশকের ক্রিকেটে বাজারমুখী এবং বিপণনের উপযুক্ত একটা কাঠামো গড়ে উঠেছিল – যা ১৯৭০এর দশকে ছিল না।”

প্যাট মার্ফি বলছিলেন, খেলোয়াড়দের জন্য এই পরিবর্তন ছিল বিরাট।

সে সময় ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলি ক্রিকেট খেলার বাইরে একটি ব্যাংক এবং ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতেন। খেলোয়াড়দের আয় ছিল খুবই কম, ১৯৭৪-৭৫-এর এ্যাশেজ সিরিজ থেকে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড যে বিপুল অর্থ আয় করেছিল, তার মাত্র দু শতাংশ পেয়েছিলেন খেলোয়াড়রা ।

“কিন্তু ওয়াল্ড সিরিজ ক্রিকেট খেলে ভিভ রিচার্ডস , গ্রেগ চ্যাপেল, ক্লাইভ লয়েড, ইমরান খান, টনি গ্রেগ – এদরে মত খেলোয়াড়রা যে অর্থ আয় করেছিলেন তা তাদের জীবনই বদলে দিয়েছিল। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের সাথে ২০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারের যে চুক্তি হয়েছিল – তা ছিল ১৯৭৭ সালে সেখানকার দেশগুলোর গড় আয়ের ৪০ গুণ বেশি। এটাই ছিল ক্রিকেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা। প্যাকার সর্বোচ্চ স্তরের ক্রিকেটকে চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছেন।”

প্রয়াত ইংলিশ ক্রিকেটার টনি গ্রেগ – যিনি কেরি প্যাকার সিরিজের মূল আয়োজকদের একজন ছিলেন, বলেছেন, ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের মাধ্যমেই এই খেলাটি পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে মানিয়ে নিয়ে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। ক্রিকেট যে টিকে থাকবে এটা নিশ্চিত হয়েছে।

“ক্রিকেট প্রশাসনকে এটা এক বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল যার খুব দরকার ছিল। খেলোয়াড়রা অনেক বেশি আয় করেছে এবং তাদের খেলোয়াড়ী জীবন দীর্ঘাযিত হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পনি বিপণনের মাধ্যম হিসেবে ক্রিকেটের মূল্য বুঝতে পেরেছে। উন্নত টিভি ক্রিকেট খেলার দর্শকের আগ্রহ বাড়িয়েছে। রাতের ক্রিকেটে তৈরি হয়েছে নতুন দর্শক। ড্রপ ইন পিচের কারণে উইকেট তৈরিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ক্রিকেটের এই সাফল্য দেখে অন্য খেলাও এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছে।”

সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল বলছিলেন, এ দুটোর মধ্যে নিশচয়ই একটা সম্পর্ক আছে। “সরাসরি উত্তরাধিকারী কিনা বলা কঠিন, তবে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট ছাড়া, আর তার ফলে যে রকম বিপণন, উন্নত টেলিভিশন কভারেজ ইত্যাদি এসেছে – এগুলো ছাড়া আইপিএল হয়তো এত সফল হতো না। তাই সে অর্থে বলা যেতে পারে যে নিশ্চয়ই আইপিএল কেরি প্যাকার সিরিজের উত্তরাধিকারী।”

কেরি প্যাকার নিজেও বলেছিলেন, তার ধারণা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তার এই বিপ্লবের কারণে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। সত্যিই কি তাই হয়েছে? প্যাট মার্ফি বলছিলেন, ক্রিকেটাররা এখন অনেক বেশি ফিট, এ্যাথলেটিক, দারুণ ফিল্ডার। তারা এখন অনেক বেশি ধনী । বিপণনও এখন অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট এখন শুধু ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার ওপরই নির্ভরশীল।

গিডিয়ন হেইগের কথায়, নিশ্চয়ই আন্তজাতিক ক্রিকেট এখন অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। তিনি বলছেন, “কেরি প্যাকার ছিলেন একজন বিপ্লবী, তিনি ক্রিকেটকে শিক্ষা দিয়েছেন যে একটা খেলার জন্য বাজার এবং টেলিভিশন স্বত্ব কত গুরুত্বপূর্ণ । টিভিই এখন ক্রিকেটের চালিকাশক্তি। কিন্তু ১৯৭৭ সালের আগে কেউই্ এ সম্ভাবনার কথা উপলব্ধি করে নি। এটা ঠিক যে কেরি প্যাকার এর সুবিধা নিয়েছেন – কিন্তু এর পর থেকে ক্রিকেট খেলা চিরতরের জন্য বদলে গেছে।”

ক্রিকেট ভাষ্যকার হেনরি ব্লোফেল্ড – যিনি ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচটির ধারাভাষ্যকার ছিলেন – বলছেন, কেরি প্যাকার যেসব পরিবর্তন এনেছিলেন সেগুলো এখন ক্রিকেটের স্বাভাবিক জিনিস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, “এখন আর আপনি আধুনিক ক্রিকেটের কোন একটা জিনিস দেখিয়ে বলতে পারবেন না যে আমার এটা ভালো লাগে না কারণ – কেরি প্যাকার এটা করেছিলেন।”

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চেলসি, শুক্রবার ওয়েস্ট ব্রমকে ১-০ গোলে হারিয়ে লিগের দুটি খেলা বাকি থাকতেই শিরোপা নিশ্চিত করে ফেলেছে তারা । কিন্তু প্রথম চারের লড়াই শেষ হয় নি। কারণ পয়েন্ট তালিকায় প্রথম চারটি দল ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার সুযোগ পাবে। তাই চেলসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবার পরও ম্যানচেস্টার সিটি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল, লিভারপুল, আর এভারটনের মধ্যে চলছে প্রথম চারে ঢোকার লড়াই।