ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ইউটিউবাররা!

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিতর্কিত কপিরাইট আইন পাসের পক্ষে ভোট দিয়েছে; সমালোচকরা বলছেন এই আইন ইন্টারনেট ব্যবহারের ধারা সম্পূর্ণ পাল্টে দিতে পারে।

নতুন নীতিমালায় (বিতর্কিত অনুচ্ছেদ ১৩ সহ) অনুমতি ছাড়া কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে কোনো কিছু ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হলে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তার দায়ভার নেবে।

তবে মিম এবং জিআইএফ শেয়ার করা এই নতুন আইনের অন্তর্ভূক্ত হবে না।

অনেক সঙ্গীতশিল্পী, চিত্র ও কারুশিল্পী মনে করেন এই নিয়ম বাস্তবায়ন হলে শিল্পীদের আর্থিক মূল্যায়ণ সঠিকভাবে হবে – কিন্তু অন্য অনেকেই মনে করে এর ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের তৈরি করা কাজ, যেগুলোকে ইউজার-জেনারেটেড কন্টেন্ট বলা হয়, ধ্বংসের মুখে পড়বে।

কপিরাইট হলো একজন ব্যক্তির আইনি অধিকার, যা ঐ ব্যক্তির তৈরি করা কোনো কাজ কোথায় এবং কীভাবে ব্যবহার হবে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বর্তমান আইনের অধীনে শিল্পীদের ন্যায্য সম্মানীই দেয়া হচ্ছে।

গুগল বলেছে, এই আইন ‘ইউরোপের ডিজিটাল ও সৃজনশীল শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত’ করবে।

এই বিতর্কিত আইনটি পাস করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ইউরোপিয়ান সংসদের ৩৪৮ জন সাংসদ, আর এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ২৭৮ জন।

বিতর্ক তৈরি হচ্ছে কী নিয়ে?

আইনের যে দু’টি ধারা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, সেগুলো অনুচ্ছেদ ১১ ও অনুচ্ছেদ ১৩ হিসেবে পরিচিত।

  • অনুচ্ছেদ ১১ অনুযায়ী, যে কোনো নিউজ ওয়েবসাইটের লিঙ্ক ব্যবহার করতে সার্চ ইঞ্জিন এবং নিউজ অ্যাগ্রিগেট প্ল্যাটফর্মগুলোকে অর্থ দিতে হবে।
  • অনুচ্ছেদ ১৩ অনুযায়ী, কপিরাইট লাইসেন্স ছাড়া যে কোনো কিছু পোস্ট করলে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়বদ্ধ করা হবে। কপিরাইট করা কাজ ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও আরোপিত হবে কড়াকড়ি। এরই মধ্যে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো কপিরাইট সহ পোস্ট করা গান এবং ভিডিও সরিয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশের ইউটিউবাররা ক্ষতির মুখে পড়বেন?

নতুন এই নীতিমালা বিভিন্ন মহলে বিতর্ক তৈরি করলেও তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন মনে করেন এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

বিবিসি বাংলাকে মি. স্বপন বলেন, “আমি মনে করি এতদিন ইন্টারনেটে যতগুলো ভালো কাজ হয়েছে এটি তার মধ্যে একটি।”

মি. স্বপন বলেন, “আমরা অনেক সময়ই আরেকজনের তৈরি করা গান বা ভিডিও শেয়ার না করে ডাউনলোড করে আপলোড করে দেই। এই আইন বলবৎ করা হলে সেই অরাজকতা থামবে এবং একইসাথে সৃজনশীল কাজ করা শিল্পীরা এই আইনের মাধ্যমে তাদের মেধাস্বত্বের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবেন।”

তবে যেই ওয়েবসাইটগুলো ৩ বছরের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে, যাদের বার্ষিক আয় ১০ মিলিয়ন ইউরোর নিচে এবং মাসিক ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ নতুন ব্যবহারকারী নেই – সেসব ওয়েবসাইট এই আইনের আওতাধীন হবে না বলে জানান মি. স্বপন।

কিন্তু এই আইন কার্যকর করার মাধ্যমে ইন্টারনেট ভিত্তিক মুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্য কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?

“এই আইনের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছে গুগল এবং ইউটিউব। কারণ তারাই পৃথিবীতে ওপেন ইন্টারনেটের নামে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করছে – যেটি তাদের ব্যবসার মডেলের মধ্যেই পড়ে।”

মি. স্বপন বলেন, “এখানে বলে রাখা ভাল যে উইকিপিডিয়াকে এই আইনের আওতায় রাখা হয়নি।”

এই আইনের সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করছে ইউটিউব। মি. স্বপন মনে করেন নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থেই এই আইনের বিরোধিতা করছে তারা।

“যে ব্যক্তি নিজে কিছু তৈরি করছে, তার কন্টেন্ট তো বাধা দেয়া হচ্ছে না। যারা ঐ একই কন্টেন্ট নিয়ে আবারো পোস্ট করছে তাদের বাধা দেয়ার জন্য এই আইন।”

তবে এই আইন কার্যকর হলে বাংলাদেশের অনেকেই ইউটিউব চ্যানেলে কন্টেন্ট তৈরি করে আয় করার ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়বেন বলে মনে করেন মি. স্বপন।

“বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক ইউটিউব চ্যানেল আছে যেখানে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কন্টেন্টকে সামান্য পরিবর্তন করে আবারো আপলোড দেয়া হয় এবং সেসব ভিডিও থেকে অনেকেই অর্থ উপার্জনও করছেন।”

“নতুন আইন বলবৎ হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তখন অরিজিনাল ভিডিওই শেয়ার করতে হবে।”

বাংলাদেশের মত যেসব দেশ সদ্যই ডিজিটাল পথে হাঁটতে শুরু করেছে সেসব দেশে এই আইনের প্রভাব পড়তে পারে বলেও মনে করেন মি. স্বপন।

“যেহেতু আমাদের নিজেদের কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই এবং আমরা বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তাই আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিশাল একটা অংশ কপিরাইট করা কন্টেন্টের ওপরই নির্ভরশীল।”

এই ব্যবহারকারীদের এখন নতুন নীতিমালার অধীনে আসতে হবে এবং কপিরাইট সংক্রান্ত আইনকে সম্মান করে চৌর্যবৃত্তির প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন মি. স্বপন।